হুমকির মুখে ইরাবতী ডলফিন

সুন্দরবনের যে জল ছিল ইরাবতী ডলফিনের স্বচ্ছন্দ্ বিচরণস্থল, তেল মিশে সেই জলই এখন হয়ে উঠেছে বিলুপ্ত প্রায় জলজ প্রাণীর কাল।

শামীমা বিনতে রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2014, 07:02 PM
Updated : 9 Dec 2014, 07:10 PM

বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় বিচরণ ক্ষেত্র বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনে ছড়িয়ে থাকা স্বাদু পানির নদী-খালগুলো।

বনের দক্ষিণ দিকের তিনটি এলাকা ২০১১ সালে এই ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে একটি চাঁদপাই রেঞ্জ।

এই চাঁদপাই রেঞ্জের কাছেই শেলা নদীতে মঙ্গলবার সকালে ঘটেছে দুর্ঘটনা, যাতে একটি তেলবাহী ট্যাংকার থেকে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ছে নদী-খালে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ডলফিন সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণার কাজ করা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুন্দরবনের পূর্বদিকের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে এই দুর্ঘটনায় পড়ায় সবচে বেশি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্বের বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন।

বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির আবাসিক প্রতিনিধি রুবাইয়াত মনসুর মোগলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেখানে দুইবার জোয়ার-ভাটা হয়। তেল এখন উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ছে। এরপর পূর্ব-পশ্চিমে ছড়াবে।

“ওখান থেকে পাওয়া ফটোগ্রাফে বোঝা গেছে, সেখানে উত্তর দক্ষিণে তেলের লাইন দেখা যাচ্ছে। ইরাবতী ডলফিনের জন্য এটাকে সিম্পলি ডিজাস্টার বলা যায়।”

এই গবেষক জানান, ইরাবতী ডলফিনের চারণক্ষেত্র আবিষ্কারের সময়ে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় ওই এলাকায় আরও পাঁচ প্রজাতির ডলফিন ও এক প্রজাতির তিমির সন্ধান মেলে।

ইরাবতী ছাড়া অন্য ডলফিনের মধ্যে রয়েছে ইন্দো-প্যাসেফিক হাম্প ব্যাক্ট ডলফিন, ফিনলেজ ডলফিন, ইন্দো-প্যাসেফিক বটল নোস ডলফিন, স্পিনার ডলফিন, পরপয়েজ ডলফিন, স্পটেড ডলফিন ও গেংগেজ রিভার ডলফিন ছাড়াও রয়েছে ব্রাইডস হোয়েলস নামের এক প্রজাতির তিমি।

সুন্দরবনের নদীতে ইরাবতী ডলফিনের বিচরণের এই ছবি ক্যামেরায় ধরেছেন বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির আবাসিক প্রতিনিধি রুবাইয়াত মনসুর মোগলি।

সুন্দরবনের নদীতে ইরাবতী ডলফিনের বিচরণের এই ছবি ক্যামেরায় ধরেছেন বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির আবাসিক প্রতিনিধি রুবাইয়াত মনসুর মোগলি।

রুবাইয়াত বলেন, সুন্দরবন এখন ইরাবতীর চারণক্ষেত্র হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত। ইরাবতী সুন্দরবনের পশ্চিম দিকে বেশি। আর সেখানেই তেল ছড়িয়ে পড়ছে।

বন সংরক্ষক তপন কুমার দে-ও ইরাবতী ডলফিনের সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

“ডলফিনের বৈশিষ্ট্য হল প্রতি ২০/২৫ মিনিট পর শ্বাস নেওয়ার জন্য গভীর পানি থেকে উঠে আসে। ফার্নেস অয়েলের ঘনত্ব মবিল, ডিজেলের মতো। ফলে পানির উপরিস্তরে ছড়িয়ে থাকা তেলের জন্য অক্সিজেন নিতে সমস্যা হবে তাদের। আমি বলব, এটা ইরাবতী ডলফিনের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়।”

প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, তেল যদি ছড়িয়ে পড়লে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে অক্সিজেনের অভাবে সমস্যায় পড়বে ডলফিনসহ যে কোনো জলজ প্রাণী।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহি অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব পুরো সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানে (ইকোসিস্টেম) পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ছড়িয়ে পড়া তেল ভারী না হালকা- তা এখনো নিশ্চিত নন জানিয়ে তিনি বলেন, “হালকা হলে এ তেল দ্রুত আশপাশের নদীতে ছড়িয়ে পড়বে। ভারী হলেও তা নদীর নিচে অবস্থান করে বিস্তার ঘটাবে।

“এটা প্রাণির লিভার ফাংশান ধীরে ধীরে অকেজো করে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি আশপাশের উদ্ভিদের স্বাভাবিক বেড়ে উঠা, নদী-খালের পাড়ে এসে যেসব প্রাণী পানি পান করে, তাদের ওপর প্রভাব পড়বে।”

তার মতে, বলতে গেলে নদী-খালের মাছ, বানর, হরিণ, গাছ-গাছালি সুন্দরবনের পুরো ইকোসিস্টেমই তেলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তেলের বিস্তার নদীর কূলেও

আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “এমনিতেই আমাদের সুন্দরবন পরিবেশগত দিক দিয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ দুর্ঘটনা এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে এর প্রভাব থাকবে।”

“আর এখন যেহেতু অতিথি পাখি আসার সময়, তাই অতিথি পাখিগুলো পানির ওপরের খাবারের সঙ্কটে পড়বে, মরে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে,” বলেন বন কর্মকর্তা তপন।

ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের শেলা নদীর জয়মানি ঘোল এলাকায় নোঙর করে ছিল এটি।

ভোর ৫টার দিকে ‘টোটাল’ নামে একটি কার্গোর ধাক্কায় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ডুবে যায়। এতে সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং এ থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে বলে মংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের কনটিনজেন্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানিয়েছেন।

বন কর্মকর্তা তপন বলেন, এই দুর্ঘটনায় তেল সরিয়ে ফেলার কোনো সামর্থ্য বনবিভাগের নেই। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ফার্নেস অয়েল।

চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক আবুল কালাম আজাদের ধারণা, ট্যাংকারের প্রায় পুরো তেলই ভেসে গেছে।

নদীতে ভাসছে তেল

সুন্দরবনের ভেতরে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় নদী-খালে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিকালে ভাটার সময় এলাকা ঘুরে তার মনে হয়েছে।

বিকাল নাগাদ সুন্দরবনের জয়মনি, বেলতলা, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী প্রভৃতি এলাকায় নদীতে তেলের আস্তর দেখা গেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস শহীদ রুহুল আমিনকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান খান।

নৌবাহিনীর এই জাহাজে ভাসমান তেলের আস্তরকে ভারী ও একত্রিত করার মতো রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে বলে জানান তিনি।

১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) ঘোষণা করে ইউনেস্কো। এই ঘোষণার পর এর পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগও চলতে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই ঘটনা এমন এক সময়ে হল, যখন ইউনেস্কো হেরিটেজ হিসাবে সুন্দরবনকে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ-প্রতিবেশগত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ বার বার দিচ্ছিল।

“পুরো সুন্দরবনের খাল নদী-নালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়বে তেল। জোয়ারের সময় পানি উপরে উঠবে এবং ভাটার সময় গাছে, মাটিতে লেগে থাকবে তেল। জমে থাকা সেই তেলই হবে মাটি এবং পানির মাছ-প্রাণী, গাছ-পালার জন্য কাল।”

সুন্দরবনের ভেতরে কেন এই চলাচল?

সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে কেন তেলবাহী নৌযান চলাচল করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। বন কর্মকর্তারা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা দিয়েও তা কার্যকর করতে পারছেন না তারা।

সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণার পর পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে থাকে সরকার।

ডুবন্ত তেলবাহী ট্যাংকারটি

২০১১ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় বন বিভাগ।

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সেখানে কিভাবে তেলবাহি ভারী নৌযান চলাচল করতে পারল- এই প্রশ্ন তুলেছেন পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আঞ্জুমান ইসলাম।

তিনি মনে করেন, এই বিপর্যয় ভয়াবহ বিপর্যয় হবে, যদি না তেল সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়।

নিষেধাজ্ঞার পরও কেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে- জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হুসাঈন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিআইডব্লিউটিএকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও তারা সুন্দরবনকে গুরুত্ব না দিয়ে চলাচল অব্যাহত রেখেছে।”

অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এ ধরনের নৌচলাচল কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। বিকল্প আপাতত না থাকলেও সুন্দরবনকে রক্ষায় বিকল্প খুজে বের করতে হবে। সরকারকেও কঠিন হতে হবে।  

“বন বিভাগ বারবার আপত্তি জানিয়ে এসেছে। কিন্তু নৌ মন্ত্রণালয় যদি বলে নৌপথ আমার, বন তোমার। তাহলে সুন্দরবন রক্ষা করা যাবে না।”

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন মঈনুল হক চৌধুরী ও অলীপ ঘটক)