ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনের জলে ভাসছে তেল

সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি জ্বালানি তেল নিয়ে সুন্দরবনে ট্যাংকারডুবিতে এ বিশ্ব ঐতিহ্যের পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বন কর্মকর্তা ও পরিবেশ গবেষকরা।

অলীপ ঘটকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2014, 03:11 PM
Updated : 9 Dec 2014, 07:50 PM

মঙ্গলবার ভোরে ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটির প্রায় সব ফার্নেস অয়েল বেরিয়ে বিকাল নাগাদ সুন্দরবনের শেলা নদীতে অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে পানিতে ভেসে থাকা এই জ্বালানি তেল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হুসাঈন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তেল দূষণের কারণে মৃগমারী-নন্দবালা-আন্ধারমানিক ডলফিন অভয়াশ্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এখান থেকে ডলফিনের বসতি সরে যেতে পারে।”

বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের (যা শুশুক নামে পরিচিত) সবচেয়ে বড় বিচরণ ক্ষেত্র সুন্দরবন। শেলা নদী সংলগ্ন এলাকা এই জলজ প্রাণির অভয়াশ্রম হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষিত।

প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তেল যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে ডলফিন। অন্য জলজ প্রাণীও অক্সিজেন সঙ্কটে ভুগবে।”

শুধু ডলফিন নয়, শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের গাছপালা ও জলজ সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত।

তিনি বলেন, “এত পরিমাণ তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় প্রাণি বৈচিত্র্যের ওপর এর মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।

“সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে অক্সিজেন নেয়। এই তেলের আস্তর জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হলে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে গাছ মারা যাবে।”

ভাটি এলাকায় পানির ভালো প্রবাহ না থাকায় সাগরের জোয়ার-ভাটায় দ্রুত এই বর্জ্য অপসারণের সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন তিনি।

সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক আবুল কালাম আজাদ বিকালে ঘটনাস্থল থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ট্যাংকারটির সামনের অংশ ডুবে আছে। পেছনের অংশ পানির ওপর রয়েছে।

ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাচ্ছিল।

সোমবার বিকালে রওনা হওয়া ট্যাংকারটি রাতে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের শেলা নদীর জয়মানি ঘোল এলাকায় নোঙর করেছিল।

মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে ‘টোটাল’ নামে একটি কার্গোর ধাক্কায় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ডুবে যায় বলে মংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের কনটিনজেন্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কার্গোর ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং এ থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে। 

ট্যাংকারটিতে থাকা সাড়ে ৩ লাখ লিটার তেলের মধ্যে কী পরিমাণ ছড়িয়ে পড়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

সহকারী বন সংরক্ষক আবুল কালাম আজাদের ধারণা, ট্যাংকারের প্রায় পুরো তেলই ভেসে গেছে।

সুন্দরবনের ভেতরে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় নদী-খালে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিকালে ভাটার সময় এলাকা ঘুরে তার মনে হয়েছে।

বিকাল নাগাদ সুন্দরবনের জয়মনি, বেলতলা, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী প্রভৃতি এলাকায় নদীতে তেলের আস্তর দেখা গেছে।

আবুল কালাম বলেন, “তেলের প্রবাহ ডলফিন অভয়াশ্রমের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। রাতের জোয়ারের আগেই তা শেলা নদী সংলগ্ন ডলফিন অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়বে।”

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস শহীদ রুহুল আমিনকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান খান।

নৌবাহিনীর এই জাহাজে ভাসমান তেলের আস্তরকে ভারী ও একত্রিত করার মতো রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে বলে জানান তিনি।

“এটাকে কাজে লাগাতে পারলে ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে,” বলেন কমোডর হাবিব।

মংলার নালা ও রামপালের কুমার নদী ভরাট হয়ে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

তখন থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শেলা নদীকে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ।

পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির কারণে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এই নৌপথ বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে জয়মনির ঘোল এলাকায় সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার নিয়ে একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। তার আগে ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া এলাকায়ও ক্লিংকারবাহী একটি কার্গো ডুবে যায়। ওই জাহাজ দুটি এখনও ওঠানো সম্ভব হয়নি।