কোনো দেশ পাশে না থাকলে মরে যাব না: প্রধানমন্ত্রী

যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির বিরোধিতার পরও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হতে পারে, তাহলে কোনো একটি দেশকে পাশে না পেলেও এখন বাংলাদেশের সমস্যা হবে না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2014, 11:49 AM
Updated : 5 Dec 2014, 02:55 PM

আর কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলেই একটি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে বলেও তিনি মনে করেন না।

শুক্রবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালের সাম্প্রতিক সফর নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের এই প্রতিক্রিয়া।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেতে পারে বলে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এক সাংবাদিক।

শেখ হাসিনা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের যে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন, তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কেউ যদি কোনো মতামত দিয়ে থাকেন তাহলে সে দায়িত্ব তার। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তা করা হয়েছিল বলেও শোনা গেছে।

“আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সারা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রমাণ পায়নি।”

কোনো সমস্যা হলেই কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে বলে মনে করেন না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আর একটা দেশ পাশে না থাকলে আমরা একেবারে শেষ হয়ে যাব? ... একাত্তরেও যুক্তরাষ্ট্র বিরুদ্ধে ছিল বাংলাদেশ শেষ হয়ে যায়নি।”

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যাতে না হয় সেজন্য ‘সব রকম চেষ্টা’ যুক্তরাষ্ট্র করেছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের বন্ধু রয়েছে। তাদের সহযোগিতা বাংলাদেশ সব সময় পেয়েছে।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি আমরা লড়াই করে টিকে থাকতে পারি তাহলে স্বাধীন দেশ হিসাবে এখনো পারব।”

“প্রত্যেকটা নাগরিককে বলব, এটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সে মর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। কেউ পাশে থাকলে বাঁচব, না থাকলে মরে যাব, এটা ঠিক না।”

ভাল থাকলে বন্ধুর অভাব হবে না বলেও মন্তব্য করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত স্বচ্ছ। এটা পূর্ব না পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ- তা আমি বিবেচনায় নিতে চাই না।... বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কারো সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করতে হয়, তা করব।”

কাউকে ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না- এমন চিন্তা ‘না থাকাই ভাল’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অষ্টাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ও মালয়েশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে বিকাল ৪টায় গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী প্রথমে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ও এরপর মালয়েশিয়া সফর নিয়ে বক্তব্য দেন এবং সবশেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও উপদেষ্টাদের উপস্থিতিতে তার এই সংবাদ সম্মেলন রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

“মাটি আমাদের অনেক শক্ত”

এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ‘বানচাল’ করা।

“বিএনপি নেত্রীর দুঃখ- তিনি যাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। তাদের বিচার হচ্ছে।”

যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত যে ১৩টি রায় এসেছে তার মধ্যে জামায়াতের সাত শীর্ষ নেতা ও তাদের জোটসঙ্গী বিএনপির দুই নেতা রয়েছেন।

এই বিচার ঠেকাতে গত বছর সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা চালায় একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী।

সেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই বিএনপি সরকারের পতন ঘটাতে চায় মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা নির্বাচিত সরকার। মাটি আমাদের অনেক শক্ত।” 

‘কোথায় দুর্নীতি- টিআই বলুক’

এক প্রশ্নের জবাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক ও প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সাধারণত বছরের তৃতীয় অর্ধে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও চলতি বছর কেন তা ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হলো- সে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন- “কী উদ্দেশ্যে?”

“কখন তারা এসব বলছে? যখন আমাদের প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক দুই। আমাদের রিজার্ভ ২২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন।”

কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে- তার ব্যাখ্যাও তিনি এই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দাবি করেন।

তিনি বলেন, “কে কার কাছ থেকে দুই টাকা খেল- তা নিয়ে যত কথা। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে। তাদের বিষয়ে চুপ।”

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে, টিআইবি কি তা বলছে?”

তিনি বলেন, সামরিক স্বৈরশাসকদের সময়ে দুর্নীতি শুরু হয়ে তা বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সেখান থেকে হটাৎ করে বেরিয়ে আসা কঠিন।

“জিয়াউর রহমান দুর্নীতির বীজ বপণ করে গেছে। আর খালেদা জিয়া তা ইন্সটিটিউলাইজড করেছে।”

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুর নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখন টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনা যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে কামিয়ে ইজ্জত কিনে এখন প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের কমিটির প্রধান। টিআইবি তো এ সম্পর্কে টু শব্দটা করে না।”

‘বেফাঁস’ কথা ও প্রশ্নফাঁস

সম্প্রতি ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে প্রধামন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি যা বলেছেন, নিজের দায়িত্বে বলেছেন।”

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে এইচ টি ইমাম বলেন, “আমি নিজে অনেক উপজেলায় গিয়েছি। সেখানে আমাদের যারা ছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে আছে। তারা বুক পেতে দিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের হামলায় পুলিশের ১৯ জন প্রাণ দিয়েছে।”

ওই বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেকে অনেক কথা বলেন। তাতে দলের ক্ষতি হতে পারে।

“ফ্রিডম অফ স্পিচ। বলার স্বাধীনতা আছে, বলতে পারেন। যারা স্বাধীনতা ভোগ করেন- তাদের একটু দায়িত্ববোধ থাকা উচিৎ।”

প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সুযোগ সন্ধানীরা সরকারের বদমান করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

“অনেকে আছে পার্মানেন্ট গভার্নমেন্ট পার্টি। তারাই ঝামেলা করছে। যখনই কেউ অপরাধ করছে- সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

আরেক প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করা কঠিন ছিল।

“আমরা বলেই তাদের খুঁজে বের করতে পেরেছি। আমরা ‘কে, কি’ তা দেখিনি। কে কার জামাই, কার ভাগিনা দেখিনি।... আমরা অপরাধীকে অপরাধী হিসাবেই দেখি। কোনো দল হিসাবে দেখি না।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলামকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা নিয়েও সবার সোচ্চার হওয়া উচিৎ ছিল বলে শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন।