শেষ কথাটি বলা হল না কাইয়ুম চৌধুরীর

তখন রাত ৮টা ৪০, আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি কথা বলা শুরু করার আগেই ডায়াসে ফিরে আসেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, একটু আগেই যিনি বক্তৃতা শেষ করেছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2014, 07:55 PM
Updated : 1 Dec 2014, 03:38 AM

‘আমার একটি কথা বলার রয়েছে’- একথা বলে ওঠার পরপরই হঠাৎ ঢলে পড়ে যান কাইয়ুম চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে, কিন্তু বাঁচানো যায়নি তাকে।

কী কথা বলার ছিল, তা অজানা রেখেই রোববার বিদায় নিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, যার মুন্সীয়ানায় প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জাই বইয়ের ভেতরের কথা বলে উঠত বলে সবাই স্বীকার করেন।

“তার একটা বই হাতে নিলেই পাঠক বইয়ের বিষয়বস্তু প্রচ্ছদে দেখতে পাবে। এটা করার আর কেউ রইল না,” কাইয়ুম চৌধুরী আকস্মিক প্রস্থানে প্রকাশকদের সেই অভাব বোধের কথাই ফুটে উঠল মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হকের কথায়।

১৯৫৪ সালে আর্ট কলেজে লেখাপড়ার পর তেল ও জলরঙে আবহমান বাংলাকে চিত্রকলার আধুনিক রীতিতে উপস্থাপনে মনোযোগী হলেও অনেকটা জীবিকার প্রয়োজনেই বইয়ের প্রচ্ছদ করতে শুরু করেন কাইয়ুম চৌধুরী।

বইয়ের প্রচ্ছদের শিল্পমানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে ৮২ বছর বয়সেও কাইয়ুম চৌধুরীর বিদায়ে অভাববোধ প্রকাশকদের।

আর যে বিভাগে তিনি পড়িয়েছেন, সেই চারুকলার এখনকার শিক্ষক আবুল বারক আলভীর ভাষায়, “উনি তো একজন প্রবাদ পুরুষ। শুধু ফাইন আর্টস না, গ্রাফিক্স ডিজাইনে উনার বিরাট অবদান।”

কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ফেনীতে, ১৯৩২ সালে। ক্ষয়িঞ্চু জমিদার-পরিবারে জন্ম হলেও পরিবারে শিক্ষা ও উদার মানসের জোরদার অবস্থান ছিল। বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় কর্মকর্তা।

মক্তবে শিক্ষার হাতেখড়ি হলেও পরে তিনি ভর্তি হলেন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। বাবার কর্মস্থল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার শিক্ষাজীবনও চলতে থাকে ঘুরে ঘুরে। চট্টগ্রামের পর কুমিল্লা, নড়াইল, সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, ফেনী, ফরিদপুর হয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪৯ সালে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে।

স্কুল জীবন থেকে আঁকাআঁকির ঝোঁক দেখে কাইয়ুম চৌধুরীর বাবাই ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তির বিষয়ে জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আলোচনা করেন। আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তির পর কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৫৪ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করেন।  

পড়ার সময়ই ১৯৫২ সালের ২১ একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার পর আর্টস ইনস্টিটিউটের নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনিও শরিক হন।

১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে সদরঘাট থেকে বের হওয়া মিছিলে চিত্রিত ফেস্টুন নিয়ে আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলেন এবং মিছিলের পুরোভাগে রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীরের সঙ্গে ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীও।

২২ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে ফাইন আর্টস বিভাগ থেকে পাস করার পর তিনি কোনও পেশায় যোগ না দিয়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ করেছেন।

ওই সময়ের বর্ণনা করে এক সাক্ষাৎকারে কাইয়ুম চৌধুরী নিজেই বলেছেন, “শিল্প সমালোচকেরা বলতেন, আমার ছবি ‘ছবি’ হয় না।”

সাময়িক পত্রিকা বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী ‘ছায়াছবি’ নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল।ওই বছরই তিনি অংশ নেন বর্ধমান ভবনে আয়োজিত নিখিল পাকিস্তান চিত্রপ্রদর্শনীতে।

১৯৫৫ সালে সৈয়দ শামসুল হকের দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। কিন্তু প্রকাশক অপারগ হওয়ায় সে বই আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৫৬ সালে সহশিল্পী মুর্তজা বশীর ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গড়ে তোলেন 'পেইন্টার্স ইউনিট'। ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত হয় পেইন্টার্স ইউনিটের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী, যাতে কাইয়ুম চৌধুরী ছয়টি জলরঙ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন।

তার কাজের বৈশিষ্ট্য বুঝতে সহায়তা করে ওই বছরই আঁকা তেলরঙে আঁকা ‘মহাজন’ ও জলরঙের ছবি ‘নিশ্চল নৌকা’।

১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলছিল তার ডিজাইন ও প্রচ্ছদ অঙ্কনের কাজ।

এই বছরই প্রকাশিত জহুরুল হকের ‘সাত-সাঁতার’ গ্রন্থে প্রচ্ছদের কাজ করে এক্ষেত্রে একটি পালাবদল ঘটান তিনি।প্রচ্ছদের নিছক দৃষ্টিনন্দন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তিনি যোগ করলেন বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনা।

ব্যবহারিক শিল্প সংক্রান্ত কাজে কাইয়ুম চৌধুরী আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন। বিশেষভাবে তার স্ফূর্তি ছিল বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনে এবং এই কাজে তিনি অচিরেই এক অতুলনীয় মাত্রা অর্জন করলেন।

 ১৯৫৯ সাল বার্ডস অ্যান্ড বুকস প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বইটির প্রচ্ছদ আঁকেন কাইয়ুম চৌধুরী।

ওই বছরই জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ১৯৬১ সালে আবদুশ শাকুরের ‘ক্ষীয়মাণ’ ও সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’র প্রকাশনার সঙ্গে তিনি সক্রিয় ছিলেন।

এত প্রচ্ছদের মধ্যে নিজের সেরা বলে কোনটিতে বেছে নেবেন- এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হলে তিনি

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই ‘একদা এক রাজ্যে’র কথাই বলেন।

১৯৬০ সালে ফাইন আর্টস বিভাগে তার সহপাঠী তাহেরা খানমের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।ওই বছরই আর্ট কলেজ ছেড়ে যোগ দিলেন কামরুল হাসানের নেতৃত্বে নবগঠিত ডিজাইন সেন্টারে।

১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজাভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। ইংরেজি দৈনিক ছাড়াও সিনে-সাপ্তাহিক 'চিত্রালী'তেও কাজ করেছেন তিনি।

১৯৬৫ সালের ২০ অক্টোবর তিনি আবার আর্ট কলেজের কমার্শিয়াল আর্ট বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি সহকারী অধ্যাপক, ১৯৮৬ সালের ১৬ জানুয়ারি সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান কাইয়ুম চৌধুরী। 

পরিবর্তিত নাম চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান ১৯৯৪ সালে। তবে সর্বশেষ ২০০২ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে পাঠদান অব্যাহত রাখেন।

এর পর থেকে তিনি ফ্রিল্যান্স শিল্পী ও গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

এ বছর স্বাধীনতা পদক নেন কাইয়ুম চৌধুরী

পাস করার কয়েক বছর পরেই ১৯৬০-৬১ সালে চারুকলায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান। ৬১ সালে অল পাকিস্তান আর্টা এক্সিবিশনে প্রদর্শিত ‘বটম’ নামের একটি চিত্রের জন্য প্রথম পুরস্কার পান। চার বছর পর রয়্যাল কোর্ট ইন তেহরান বিয়েনাল পদক পান।

১৯৭৭ সালে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে একুশে পদক, ১৯৯৪ সালে ৬ষ্ঠ বঙ্গবন্ধু পদক ও ১৯৮৩ সালে বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য লাইপসিস বুক ফেয়ার পুরস্কার পান তিনি।

এছাড়া ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল বুক সেন্টারের বইয়ের নকশার জন্য স্বর্ণপদক পান তিনি।সেরা প্রচ্ছদের জন্য ১৯৮৮, ৮২, ৮১, ৭৯, ৭৮, ৭৫, ৭০, ৬৬, ৬৪ ও ৬৩ সালে প্রথম পুরস্কার পান তিনি।

১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে রেলওয়ে টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কারটি লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী।

এছাড়া ২০০২ সালে শেলটেক পুরস্কার ও ১৯৯৯ সালে সুলতান পদক পান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট ডিজাইন এবং ম্যুরাল কমিটির সদস্য ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। বাংলাদেশে প্রচলিত কয়েকটি টাকার নোটের ডিজাইন তারই করা।