অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকেই চলে গেলেন কাইয়ুম চৌধুরী

কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই, এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বরেণ্য এই চিত্রশিল্পী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2014, 03:11 PM
Updated : 1 Dec 2014, 04:04 AM

রোববার রাতে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উৎসবে ব্ক্তৃতা রাখতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যান কাইয়ুম চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নেওয়া হয় কাছের ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)।

সেখানে চিকিৎসকরা দেখে তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে হাসপাতাল সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছে।

এরপর বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ওই উৎসবের মঞ্চ থেকে এই শিল্পীর মৃত্যুর কথা জানানো হয় এবং অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সোমবার সকাল ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত শিল্পীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে।

একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত কাইয়ুম চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গভীর শোক জানিয়েছেন।

বেঙ্গলের সঙ্গীত উৎসবের তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে মঞ্চে উঠে বক্তৃতা রেখেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে থাকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহসম্পাদক চিন্তামন তুষার জানান, কাইয়ুম চৌধুরী বক্তৃতা দেওয়ার পর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী এ সময় ডায়াসে ফিরে বলেন- ‘আমার একটি কথা বলার রয়েছে’।

কিন্তু সে কথা বলার আগেই  ৮টা ৪০ মিনিটে হঠাৎ পড়ে যান কাইয়ুম চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এতে অনুষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বলেন, পড়ে গিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী মাথায় আঘাত পেয়েছেন।

এরপর হাসপাতালে নেওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুর কথা জানা যায়। কী কথাটি তিনি বলতে চেয়েছিলেন, তা আর জানা যায়নি।

এ বছর স্বাধীনতা পদক নেন কাইয়ুম চৌধুরী

কাইয়ুম চৌধুরীর মরদেহ রাজধানীর পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালে রাখা হয়েছে। সেখানে থাকা সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সাংবাদিকদের জানান, সোমবার সকালে মরদেহ নেওয়া হবে প্রথমে চারুকলা ইনস্টিটিউটে।

সেখান থেকে সকাল ১১টায় কাইয়ুম চৌধুরীর মরদেহ নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সবার শ্রদ্ধা জানানোর পর দুপুর ১টায় মরদেহ জানাজার জন্য নেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে।

এরপর আজিমপুর কবরস্থানে কাইয়ুম চৌধুরীকে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষে সংস্কৃতিমন্ত্রী জানান।

কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই গভীর রাতে ছুটে আসেন স্কয়ার হাসপাতালে। 

আসাদুজ্জামান নূর  সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা অনেক বড় একজন অভিভাবককে হারালাম। তিনি সব সময় আমাদের সঙ্গে থেকেছেন, আমাদের পথ দেখিয়েছেন। আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

“শুধু একজন শিল্পী বললে তার সঠিক মূল্যায়ন হবে না। তিনি অত্যন্ত উঁচু স্তরের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সবসময় তিনি ধারণ করেছেন, জীবনে কখনো আপস করেনি।”

এই শিল্পীর শেষ সময়টায় পাশে থাকতে না পেরে আক্ষেপ করলেন আরেক চিত্রশিল্পী রফিকুন্নবী।

“আজকে সারাদিন একসঙ্গে ছিলাম। সংগীতানুষ্ঠানেও আমাকে যেতে, তার বক্তব্য শুনতে তাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি কেন যে গেলাম না.. এ বিষয়টা আমাকে পীড়া দিচ্ছে।”

তার ভাষায়, কাইয়ূম চৌধুরীর প্রয়াণের অর্থ হলো দেশে শিল্পকলার একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি।

“তিনি শুধু ছবি আঁকায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। সাহিত্য-কবিতার জগতে তার কর্ম আছে। অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেছেন তিনি। ছোটদের জন্য লেখালেখি করেছেন। সামাজিক ও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতেন।”

১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৫৪ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টসে ডিগ্রি নেন। এরপর নিজের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকায় মনোযোগী হয়েছিলেন তিনি।

বইয়ের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার পাশাপাশি তেল ও জল রঙে আবহমান বাংলা ও বাংলার লোকজ উপাদানগুলোকে চিত্রে  আধুনিক ফর্মে ফুটিয়ে তোলার জন্য কাইয়ুম চৌধুরীর কৃতিত্বকে স্মরণ করেন তার অনুজরা।

জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকার মধ্য দিয়ে এই শিল্পে তার পদচারণা শুরু। বিশ্লেষকরা বলেন, বইয়ের প্রচ্ছদের শিল্পমানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।

কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র প্রচ্ছদশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীই। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম দিককার গ্রন্থগুলোর প্রচ্ছদও তার তুলিতেই আঁকা হয়।

২০০৮ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তুলি হাতে কাইয়ুম চৌধুরী

১৯৫৭ সালে আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন কাইয়ুম চৌধুরী। আর্ট কলেজে নিজের দুই বছরের কনিষ্ঠ তাহেরা খানমকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন তিনি।

ওই বছরই কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজ ছেড়ে যোগ দেন কামরুল হাসানের নেতৃত্বে নবগঠিত ডিজাইন সেন্টারে। ১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজাভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি।

পরে ১৯৬৫ সালে আবার আর্ট কলেজে ফিরে যান কাইয়ুম চৌধুরী, চারুকলা ইনস্টিটিউট হওয়ার পর এর অধ্যাপক হিসেবে ১৯৯৪ সালে অবসর নেন তিনি।

প্রায় দুই দশক আগে দৈনিক প্রথম আলো বের হলে এর সঙ্গে যুক্ত হন কাইয়ুম চৌধুরী। এরপর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন তিনি।

শিল্পকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৬ সালে একুশে পদক লাভের পর ২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান তিনি। এছাড়াও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শেলটেক  পুরস্কার, সুলতান পুরস্কারসহ বহু দেশি-বিদেশি সম্মাননা পান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট ডিজাইন এবং ম্যুরাল কমিটির সদস্য ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। বাংলাদেশে প্রচলিত কয়েকটি টাকার নোটের ডিজাইন তারই করা।