‘ইরাক স্বপ্ন’ ভেঙে রইল দেনার খাঁড়া

ধানি জমি, চাষের বলদ বিক্রি, কেউ বা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে কয়েক লাখ টাকা যোগাড়ের পর যাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই তারাই প্রতারণার অভিযোগে আটক হওয়ার পর যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে দরিদ্র ওই মানুষগুলোর।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2014, 09:56 AM
Updated : 27 Nov 2014, 10:13 AM

“যখন জানলাম ওরা প্রতারক তখন মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়লো। মনে হইলো আমি দুনিয়াতে নাই। চাচা, খালাগো থাইক্যা ধার করা টাকা কেমনে ফেরত দিমু তাও তো কইতে পারুম না,” কবে, কীভাবে ইরাক যাচ্ছেন সে তথ্য জানতে কয়েক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় উদ্ধার হওয়ার পর এভাবে নিজের অবস্থা বর্ণনা করেন বগুড়ার মজনু মণ্ডল।

তিনি জানান, র‌্যাবের হাতে আটক ঝিনাইদহের মিজানুর রহমান ইরাকে নেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়েছিলেন। কীভাবে, কবে ইরাকে পাঠাবেন জানতে চাইলে তাকে ঢাকায় আসতে বলা হয়।

“এরপর প্রায় কয়েক সপ্তাহ ঢাকার ফার্মগেইট এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে আমিসহ কয়েকজনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল মিজান। তবে বিদেশে পাঠানোর কোনো চেষ্টা তার মধ্যে দেখছিলাম না।”

মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে নয়জনকে আটক করে র‌্যাব। পাচারের জন্য ঢাকায় আনা ১৮ জনকে এ সময় উদ্ধার করা হয়, তাদেরই একজন এই সুজন মণ্ডল।

সুজনের মতো প্রতারিত হয়েছেন টাঙ্গাইলের নাগরপুরের বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার, স্বচ্ছলতার স্বপ্ন হারিয়ে দেনা শোধ নিয়ে এখন আতঙ্কে যিনি।

“স্বপ্নগুলা সব ভাইঙ্গা চুরমার হইয়া গেসে। বাঁইচা থাকার শেষ অবলম্বনটাও হারাইয়া ফেলসি। কেমনে ধারের টাকা শোধ করমু কইতে পারি না,” বলেন প্রশান্ত।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে র‌্যাব- ২ এর কার্যালয়ে আলাপকালে কাজের সন্ধানে ইরাকে যেতে চাওয়া, পরিবারের মুখে হাসি ফুটানোর স্বপ্ন আর প্রতারণার শিকার হয়ে ‘স্বপ্নভঙ্গের বেদনার’ পাশাপাশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলে যান তিনি।

প্রশান্তের বাবা কৃষ্ণচন্দ্র টাঙ্গাইলে মাছ বিক্রি করেন। প্রশান্ত বড় ছেলে। জমি বন্ধক রেখে আরেক ছেলে চন্দনকে কয়েক মাস আগে ইরাকে পাঠিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। পরিবারে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রশান্তকেও দেশের বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলেন।

গত কোরবানির ঈদের আগে টাঙ্গাইলের সখিপুরের বাসিন্দা মো. শওকত আলী (প্রতারণার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক) প্রশান্তের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছয় লাখ টাকায় তাকে ইরাকে পাঠানোর প্রস্তাব দেন।

সেখানে মাসে ৪৫ হাজার টাকা বেতনে প্রশান্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করবে বলেও তার পরিবারের সদস্যদের বলা হয়।

এজন্য প্রথমে পাসপোর্ট করার কথা বলে শওকত এক লাখ টাকা নেন তার পরিবারের কাছ থেকে। এরপর দুই মাসে প্রশান্ত আরও তিন লাখ টাকা তার হাতে তুলে দেন। গত বৃহস্পতিবার প্রশান্তকে ইরাকের ফ্লাইটে তুলে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন শওকত। তার আগে গুলশানের আল আমিন মেডিকেল সেন্টারে তার শারীরিক পরীক্ষাও হয়।

তবে ঢাকায় এসে ইরাকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই শওকত গড়িমসি করতে থাকেন বলে জানান প্রশান্ত।

প্রশান্তর সঙ্গে উদ্ধার টাঙ্গাইলের বাসিন্দা আমিন বলেন, “বিদেশে যাওয়ার কথা বইলা মামার থেইকা ৬০ হাজার, খালুর থিকা ৫০ হাজার আর দুই চাচার কাছ থাইকা ৯০ হাজার টাকা ধার নিসিলাম।

“এখন টাকা কেমনে ফেরত পামু বুঝতে পারছি না।”

একইভাবে টাঙ্গাইলের সখিপুরের বাসিন্দা তোফাজ্জল, আজিজ, আমিনুল, আরিফও ইরাকে যাওয়ার জন্য শওকতকে চার লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন।

ইরাকে পাঠানোর কথা বলে এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের ফার্মগেইটের ওই আবাসিক হোটেলে তুলেছিলেন মিজানুর-শওকত ও তাদের সহযোগীরা।

র‌্যাব ২ এর অপারেশন কর্মকর্তা মারুফ আহমেদ বলেন, ‘প্রতারকরা’ উদ্ধার হওয়া ১৮ জনের কাছ থেকে অর্ধ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছিল। প্রতারণার শিকার এসব যুবকেরা দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজ, গাড়ি চালানো, রিকশা মেরামতসহ নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করে আসছিলেন বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তারা।

তাদের কাছে বেশ কিছু জাল ভিসা পাওয়া গেছে জানিয়ে র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক কে এম আজাদ বলেন, “এই পাচারকারীরা ইরাকে লোক পাঠানোর কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

“কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে এরা প্রতারণার কাজটি সুচারুভাবে করে থাকে। এদের একটি দল নিম্ন আয়ের মানুষজনকে প্রথমত বুঝিয়ে ইরাকে যাওয়ার জন্য রাজি করায়, মোটা অঙ্কের আয়ের স্বপ্ন দেখায়।”

এরপর টাকা নেওয়া হয়ে গেলে পাচারকারীরা কৌশলে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতো জানিয়ে তিনি বলেন, “পাচারকারীরা বলতো ইরাকে যাওয়ার আগে দুবাই বা ওমানে ট্রানজিট ভিসায় যেতে হবে। দুবাই বা ওমানের আসল ট্রানজিট ভিসা জোগাড় করে দিতো তারা।

“তবে কেউ কেউ ট্রানজিট ভিসায় দুবাই বা ওমানে যেতে পারলেও ইরাকের ভিসাটি বৈধ না হওয়ায় তারা আর ইরাকে যেতে পারতেন না। উল্টো ভুয়া ভিসা নিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগে সেদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হতেন তারা।”

তবে ইরাকের ভুয়া ভিসার পরও শুধু ট্রানজিট ভিসায় কীভাবে লোকজন দুবাই বা ওমানে যাওয়ার সুযোগ পেত সে ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা আজাদ।

“এ ক্ষেত্রে প্রতারকচক্রের সঙ্গে বিমানবন্দরের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা বা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” বলেন তিনি।