শফিউল খুন: ভিন্ন ভাবনা নিয়েই এগুচ্ছে পুলিশ

ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামকে খুন করা হয়েছে বলে র‌্যাব দাবি করলেও তা মানতে নারাজ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সংস্থা পুলিশ।

রাজশাহী প্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2014, 03:06 PM
Updated : 24 Nov 2014, 03:48 PM

ছয়জনকে আটক করে র‌্যাবের বক্তব্যের এক দিনের মধ্যে রাজশাহী মহানগর পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, তাদের তদন্তে হত্যার পেছনে ব্যক্তিগত কোনো বিষয় খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবিরের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে এখনও মনে করছে পুলিশ এবং তার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

গত ১৫ নভেম্বর ক্যাম্পাস সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় নিজের বাসার কাছে শফিউল খুন হওয়ার পর ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ বলেছিল, ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।

এরপর রাজশাহীর যুবদল এবং ছাত্রদল নেতাসহ ছয়জনকে আটকের পর রোববার ঢাকায়েএক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব দাবি করে, কোনো জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা নয়, ‘অপমানের’ প্রতিশোধ নিতে এই ব্যক্তিরা হত্যাকাণ্ড ঘটান।

সোমবার আরএমপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনার মোহাম্মাদ শামসুদ্দিন বলেন, “অধ্যাপক শফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদ্ধারে আরও তদন্তের প্রয়োজন। তবে আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।”

তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ ১১ জনের মধ্যে আগেই শিবিরকর্মী সাগর, জিন্না ও আরিফকে গ্রেপ্তার করেছিলেন তারা।

“এদের মধ্যে দুজন সরাসরি হামলায় অংশ নেয় এবং ওই সময়ে তাদের ব্যবহৃত পোশাকও উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে তাদের ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোনের পেছনের অংশ পুলিশ উদ্ধার করেছে।”

এই কাঁচা পথেই খুন হন অধ্যাপক শফিউল

শামসুদ্দিন জানান, এরা আগে জামায়াত-শিবিরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে এই তিনজন একাধিকবার অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে সাগরের বিরুদ্ধে চারটি, জিন্নার বিরুদ্ধে তিনটি ও আরিফের বিরুদ্ধে একটি মামলা আছে।

পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ১১ জনের মধ্যে আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার আদালতের মাধ্যমে পুনরায় রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

আরএমপি কমিশনার বলেন, “ঘটনার পর পুলিশ ব্যক্তিগত, পেশাগত ও জঙ্গি ইস্যুকে সামনে রেখে তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যক্তিগত কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি। তবে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্য থেকে পেশাগত বিরোধের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

“আর জঙ্গি ইস্যুতে তদন্তে ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ দুটি বিষয়কে সামনে রেখে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এক-দুইদিনের মধ্যেই হত্যার মোটিভ নিশ্চিত হওয়া যাবে।”

পুলিশ কমিশনার বলেন, র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ছয়জনকে রাজশাহীতে আনা হচ্ছে। ওই ছয়জনের সামনে তাদের কাছে গ্রেপ্তার তিন শিবিরকর্মীকে মুখোমুখি করা হবে।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তাররা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আবদুস সামাদ পিন্টু (৩৪), কাটাখালী পৌর যুবদলের নেতা আরিফুল ইসলাম মানিক (৩৩), ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ইব্রাহিম খলিল ওরফে টোকাই বাবু (২১), মুদি দোকানি সিরাজুল ইসলাম ওরফে কালু (২২), বেকার যুবক আল মামুন (৩১) ও মো. সবুজ শেখ (১৮)।

র‌্যাবের ভাষ্য, পিন্টুর স্ত্রী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার সেকশন অফিসার নাসরিনের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের কারণে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউলকে খুন হতে হয়েছে।

হত্যার পরিকল্পনায় জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল এবং মাছ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী জামাই বাবু নামে আরো দুজন জড়িত বলেও র‌্যাবের দাবি।

রাজশাহী ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন

তবে রাজশাহী মহানগর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের বক্তব্যের বিরোধিতা করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার দাবি জানায়।

গত ১৫ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর আনসার আল ইসলাম-২ নামে খোলা একটি ফেইসবুক পাতা থেকে লালনভক্ত অধ্যাপক শফিউলের হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করা হয়।

এরপর নিহতের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেও দাবি করেন, মতাদর্শিক অবস্থানের কারণে তার বাবাকে জঙ্গিরাই হত্যা করেছে। 

তারপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন সমর্থকসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিহার থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেছিলেন, “শফিউল হত্যার পেছনে জামায়াতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত জঙ্গি সংগঠনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।”

অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতিগুলো যারা তৈরি করেছেন, সেই চারজন কামারকে বগুড়া থেকে বুধবার বিকালে আটক করে রাজশাহীতে আনা হয়েছে বলেও জানান ওসি আলমগীর।

বাউলের পোশাকে শফিউল

খুনের দায় স্বীকার করে ফেইসবুকে পোস্ট

এছাড়া বগুড়া থেকে আরো দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, এই দুজনই আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামে ফেইসবুকে পাতা খুলে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করছিল।

গ্রেপ্তার দুজন হলেন- বগুড়ার মহাস্থান এলাকার একটি ক্যাডেট মাদ্রাসার শিক্ষক শরিফুল ইসলাম এবং অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র।

সংবাদ সম্মেলনে আরএমপি উপ-কমিশনার (পুর্ব) একেএম নাহিদুল ইসলাম বলেন, “এ সংগঠনের (আনসার আল ইসলাম) হোতা বগুড়ার ছাত্রশিবির নেতাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।”

গণস্বাক্ষর চলছে রাবিতে

অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ তিন দিনের গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করেছে।

গণস্বাক্ষর অভিযান চলছে

সোমবার দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান।

প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক জাহিদুল হাসান বলেন, অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে হত্যার প্রতিবাদে এ গণসস্বাক্ষর কর্মসূচি চলবে আগমী বুধবার পর্যন্ত।

“স্বাধীনতাবিরোধী, গণতন্ত্রের শত্রু যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”