‘অপমানের’ প্রতিশোধ নিতে অধ্যাপক শফিউলকে হত্যা?

অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামের ছেলে জঙ্গিদের দায়ী করার পর পুলিশের তদন্ত একই দিক নির্দেশ করলেও সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত না পাওয়ার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

নিজস্ব প্রতিবেদকও রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2014, 06:41 PM
Updated : 23 Nov 2014, 07:41 PM

রাজশাহীর এক যুবদল এবং সাবেক এক ছাত্রদল নেতাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব বলছে, ‘অপমানের’ প্রতিশোধ নিতে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষককে হত্যা করেন।

গ্রেপ্তার ছয়জন হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আবদুস সামাদ পিন্টু (৩৪), কাটাখালী পৌর যুবদলের নেতা আরিফুল ইসলাম মানিক (৩৩), ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ইব্রাহিম খলিল ওরফে টোকাই বাবু (২১), মুদি দোকানি সিরাজুল ইসলাম ওরফে কালু (২২), বেকার যুবক আল মামুন (৩১) ও মো. সবুজ শেখ (১৮)।

রাজশাহীর হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার এই ছয়জনকে নিয়ে রোববার ঢাকার উত্তরায় বাহিনীর সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব। সেখানে হত্যাকাণ্ডের কারণ ও হত্যার বর্ণনা তুলে ধরেন র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান।

র‌্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, এই হত্যা পরিকল্পনায় জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল এবং মাছ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী জামাই বাবু নামে আরো দুজন জড়িত। উজ্জ্বল ও পিন্টু পরামর্শ করে অধ্যাপক শফিউলের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজিয়ে বাকিদের নিয়ে হামলায় নেতৃত্ব দেন মানিক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার সেকশন অফিসার নাসরিনের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের কারণে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউলকে খুন হতে হয়েছে বলে র‌্যাব জানতে পেরেছে। 

মুফতি মাহমুদ বলেন, “পিন্টুর স্ত্রীর সঙ্গে অধ্যাপক শফিউল ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ করেন এবং এর জের ধরে তাকে হত্যা করার কথা গ্রেপ্তাররা স্বীকার করেছে।” 

তাদের জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্ত্রীর সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের প্রতিবাদ জানাতে শফিউল ইসলামের কাছে গিয়েছিলেন পিন্টু। কিন্তু শফিউল তাকে অপমান করে বের করে দেন। এরপর উজ্জ্বলকে নিয়ে গেলেও একইভাবে তারা অপমানিত হয়। 

“এরপরেই তারা মানিকের সাথে কথা বলে বিষয়টি জানায়,” বলেন র‌্যাবের মুখপাত্র।

মানিক সাংবাদিকদের বলেন, তাদের নেতা উজ্জ্বল এবং পিন্টুকে অপমান করায় তারা শিক্ষক শফিউলকে ‘সাইজ’ করার সিদ্ধান্ত নেন। 

র‌্যাব জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৫ নভেম্বর অধ্যাপক শফিউল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলে পিন্টু তাকে অনুসরণ করেন এবং মোবাইল ফোনে তার গতিবিধি মানিককে জানান।

সেদিন মোটর সাইকেলে এক সহকর্মীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছিলেন শফিউল। ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুরে সহকর্মীকে নামিয়ে দিয়ে চৌদ্দপাই এলাকায় বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। মহাসড়ক থেকে ২০০ গজ দূরে বাড়িতে যেতে কাঁচা রাস্তায় নামার পর তিনি হামলার মুখে পড়েন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত অধ্যাপক শফিউল ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার পথ। মহাসড়ক থেকে এই কাঁচা পথ ধরে ২০০ গজ এগোলেই তার বাড়ি।

মহাসড়ক ধরে কাঁচা পথ ধরে এগিয়ে এই বাড়ির জানালার কাছেই কুপিয়ে হত্যা করা হয় অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে।

মুফতি মাহমুদ বলেন, আতাউর রহমানের বাড়ির পাশে কাঁচা রাস্তার ওপর পৌঁছালে পিন্টু ইশারা দিয়ে মানিককে দেখিয়ে দেয়। এসময় মানিক মুখ দিয়ে শিস বাজিয়ে রাস্তার দুপাশে লুকিয়ে থাকা অন্যদের অভিযান শুরুর সঙ্কেত দেয়। এরপর সবাই মিলে অধ্যাপক শফিউলকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়।

মানিক সাংবাদিকদের বলেন, “পরিকল্পনা ছিল শফিউলের শরীরের নিচের অংশে আঘাত করার। সে অনুযায়ী সবাইকে চাকু আনতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি চাপাতি-রামদাও নিয়ে এসেছে।

“আর আচমকাই মাথায় (শফিউলের) প্রথম আঘাত করে সবুজ। এই আঘাতেই স্যার মাটিতে পড়ে যান, পরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে যে যার মতো সবাইকে চলে যেতে বলা হয়।”

পিন্টু পুরো বিষয়টি উজ্জ্বলকে মোবাইল ফোনে জানান বলে র‌্যাব জানায়। উজ্জ্বল এক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক ছিলেন।

পুলিশ জানিয়েছে, মানিক রাজশাহীর কাটাখালি এলাকার সন্ত্রাসী দল ‘মানিক বাহিনীর’নেতা। তিনি চোরাচালান, বালুমহাল ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে বিএনপি নেতাদের ভাড়াটিয়া হিসাবে কাজ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

পিন্টু ও উজ্জ্বল ব্যবসায়িক অংশীদার। ‘হোসেন এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে তারা কাজ করেন। চোরাচালানের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

অধ্যাপক শফিউলের বাসা থেকে তার যে ছাত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে, তার কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

পুলিশ যে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছিল, সে বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ বলেন, শফিউল হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্যপ্রমাণ তারা পাননি। 

গত ১৫ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর আনসার আল ইসলাম-২ নামে খোলা একটি ফেইসবুক পাতা থেকে লালনভক্ত অধ্যাপক শফিউলের হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করা হয়।

বাউলের পোশাকে শফিউল ইসলাম

দায় স্বীকার করে সেই ফেইসবুক পাতায় পোস্ট

এরপর নিহতের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেও দাবি করেন, মতাদর্শিক অবস্থানের কারণে তার বাবাকে জঙ্গিরাই হত্যা করেছে।  

তারপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন সমর্থকসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিহার থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেছিলেন, “শফিউল হত্যার পেছনে জামায়াতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত জঙ্গি সংগঠনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।”

কিন্তু র‌্যাবের কাছ থেকে ভিন্ন বক্তব্য পাওয়ার পর এই পুলিশ কর্মকর্তা রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “র‌্যাবের কাছে তথ্য আছে যে আরো কয়েকজন এই হত্যা মিশনে অংশ নিয়েছিল। এদের তিনজনকে আমরা আগেই গ্রেপ্তার করেছি। এরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের। তাই শিবিরের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছিলাম।”

অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতিগুলো যারা তৈরি করেছেন, সেই চারজন কামারকে বগুড়া থেকে বুধবার বিকালে আটক করে রাজশাহীতে আনা হয়েছে বলেও জানান ওসি আলমগীর। 

এছাড়া বগুড়া থেকে আরো দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, এই দুজনই আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামে ফেইসবুকে পাতা খুলে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করছিল। 

গ্রেপ্তার দুজন হলেন- বগুড়ার মহাস্থান এলাকার একটি ক্যাডেট মাদ্রাসার শিক্ষক শরিফুল ইসলাম এবং অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র।