পাকিস্তানি ‘জঙ্গি’র সঙ্গে গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ নেতাও

জঙ্গি সন্দেহে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি নাগরিকসহ যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে একজন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির আওয়ামী লীগ নেতা।

মিন্টু চৌধুরীও উত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2014, 05:09 PM
Updated : 23 Nov 2014, 05:55 PM

রোববার সকালে বন্দর নগরীর একটি হোটেল থেকে পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আলমের সঙ্গে গ্রেপ্তার মো. শফিউল্লাহ গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন।

গ্রেপ্তার এই পাঁচজন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) এর সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের ধারণা, এই সংগঠনটির সঙ্গে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল্লাহর দলীয় এক সহকর্মী অবশ্য দাবি করেছেন, জমি বিক্রি নিয়ে আলোচনা করতেই ওই হোটেলে গিয়েছিলেন শফিউল্লাহ।

তবে গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, কক্সবাজার ও নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি মাথায় রেখেই শফিউল্লাহসহ পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তারা।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় হায়দ্রাবাদ থেকে আরএসও সদস্য খালিদ ওরফে খালিদ মোহাম্মদ নামের এক যুবককে গ্রেপ্তারের পর এই সংগঠনটির জঙ্গিসম্পৃক্ততার বিষয়টি ওঠে আসে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে আরএসওর সঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরের বাসিন্দা শফিউল্লাহর সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে।  

তার এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শফিউল্লাহর (৩৮) বাবা ছালেহ আহমদ একসময় আরএসও’র সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নাইক্ষ্যংছড়ির প্রভাবশালী এই পরিবারের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শফিউল্লাহ রোহিঙ্গা জঙ্গিদের ‘প্রশ্রয়দাতা’ বলে পরিচিত আরএসও’র একটি পক্ষের হয়ে কাজ করেন বলেও দাবি করেন স্থানীয় কয়েকজন।

নাইক্ষ্যংছড়ি হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করা শফিউল্লাহ ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও স্থানীয়রা জানায়। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও পরে আর পড়েননি।

পরে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট কলেজ থেকে ডিগ্রি পাসের পর ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন শফিউল্লাহ।

নাইক্ষ্যংছড়ির হাজী এম এ কালাম ডিগ্রি কলেজে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে কাজ করছেন তিনি।

শফিউল্লাহ নাইক্ষ্যংছড়ির দুটি স্কুল ও একটি মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বলেও জানান স্থানীয় সাংবাদিকরা।

স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাত-আট বছর আগেও শফিউল্লাহ আওয়ামী লীগে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

“২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তার বোনজামাইকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগে আসেন তিনি।”

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাসলিম ইকবাল দাবি করেন, তার কমিটির মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক শফিউল্লাহ কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন। জায়গা-জমি বিক্রি বিষয়ে আলাপ করতেই তিনি চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলেন।”

গত ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে আনারস প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছিলেন শফিউল্লাহ।

ওই নির্বাচনে শফিউল্লাহকে ৪ হাজার ভোটে হারিয়ে জয়ী হন ১৯ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী তোফাইল আহমেদ।

বিএনপি নেতা তোফাইল কয়েক বছর আগে রামুতে বৌদ্ধবিহারে তাণ্ডবের মামলার অন্যতম আসামি। রোববার শফিউল্লাহর সঙ্গে গ্রেপ্তার ছালামত উল্লাহর বিরুদ্ধেও রামুর ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছিল।

ছালামত (৪০) কক্সবাজার জেলার লাইট হাউস এলাকার বাসিন্দা হামিদ হোসেনের ছেলে। তাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার অন্য দুজন হলেন- চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দেওয়ান নগরের আহম্মদ হোসেনের ছেলে মো. আমিন (৫৩), কক্সবাজারের উখিয়া থানার পালংখালী ইউনিয়নের আবুদল আহাদের ছেলে আবদুল মজিদ (৩১)।

গ্রেপ্তার পাকিস্তানি আলম (৪৪) করাচির বাসিন্দা মো. ইয়াসিনের ছেলে। তিনি গত বছরে দুই বার বাংলাদেশে আসেন বলে তার পাসপোর্টে দেখা যায়।

বান্দরবানের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়িতে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে।

দুর্গম পাহাড়ি এই উপজেলাতেই রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। আর রোহিঙ্গা জঙ্গিদেরকে সংগঠনটি পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশেরও ধারণা, নাসিরাবাদের হোটেল লর্ডস ইনে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিক আলমের সঙ্গে আরএসও ‘কানেকশান’ হিসেবেই বাকি চারজন সেখানে গিয়েছিলেন।

আলম নেদারল্যান্ডসভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘গ্লোবাল রোহিঙ্গা সেন্টার’ এর পরিচালক বলে গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে।

আলমের পাসপোর্ট থেকে জানা যায়, গত শুক্রবার তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে জেদ্দা থেকে বাংলাদেশে আসেন। এর আগে গত ২০ মার্চ তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং ২৪ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। দুইবারেই তিনি জেদ্দা থেকে বাংলাদেশের ভিসা নেন।

এছাড়া গত একবছরে তিনি সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাহরাইন, সুদান ভ্রমণ করেন।

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার কুসুম দেওয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া পাকিস্তানি নাগরিকসহ পাঁচজনকে বিভিন্ন দিক মাথায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। বিকাল থেকেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কক্সবাজার ও নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি মাথায় রেখেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

“এছাড়া পাকিস্তানি নাগরিকের এক বছরে দুইবার বাংলাদেশে আসার দিকটিও জিজ্ঞাসাবাদে মাথায় রাখা হচ্ছে।”

ছালামত আরএসও’র কক্সবাজারের অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে পরিচিত। কক্সবাজার সদরের লাইট এলাকায় বাড়ি করলেও তার আদি নিবাস চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতীতে।

গ্রেপ্তার মজিদ কক্সবাজারের উখিয়া পালংখালীর বাসিন্দা হলেও তার মা-বাবা রোহিঙ্গা বলে তিনি স্বীকার করেছেন পুলিশের কাছে।

মজিদের পাসপোর্টে (বাংলাদেশের) তার জন্মস্থান সৌদি আরবের মক্কা ও জন্ম তারিখ ১৯৮৩ সালের ৩ অক্টোবর লেখা আছে। গত এক বছরে মজিদ থাইল্যান্ড, ভারত, কাতার, বাহরাইন ও তুরস্ক ভ্রমণ করেছেন।