প্রতারণা ঠেকিয়ে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির তাগিদ

বিদেশে চাকরির নামে লোক পাঠিয়ে প্রতারণা ঠেকানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2014, 09:33 AM
Updated : 23 Nov 2014, 01:16 PM

কোনো ধরনের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ যাতে কাজের জন্য বিদেশে না যায় সেজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কর্মসূচি গ্রহণেরও তাগাদা দিয়েছেন সরকার প্রধান।

রোববার সকালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশেই জনশক্তির প্রয়োজন আছে। সেসব জায়গায় আলাপ- আলোচনা করলে আমরা জনশক্তি প্রেরণ করতে পারব এবং দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করতে পারব।

“দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণ একান্তভাবে দরকার। আপনারা সেই প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেবেন।”

বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে উন্নীত করার ওপর গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। আর তা করা গেলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষ মনে করে এই জনসংখ্যা আমাদের জন্য বিশাল একটা সমস্যা। আমি বক্তিগতভাবে মনে করি, এটা আমাদের জন্য সমস্যা নয়, বরং এটা আমাদের একটা সম্পদ। জনশক্তি একটা বড় সম্পদ।

“আমরা যদি তাদের কাজে লাগাতে পারি, প্রশিক্ষিত করতে পারি- তাহলে এই জনশক্তিই আমাদের নিতে পারে আমাদের যে লক্ষ্য, সে লক্ষ্যে।”

বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুসারে সেভাবে দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে। কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী বিভিন্ন দেশে পাওয়া কঠিন। কোন দেশে কোন ধরনের লোকের চাহিদা বেশি- সেটাকে একটু নিরূপণ করতে হবে।

“আমরা যদি কারিগরি শিক্ষা দিই, তাহলে আমরা স্কিল লেবার পাঠাতে পারব। দক্ষ জনশক্তি আরো বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে।”

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় ও যুব মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে সব কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে- সেগুলোর সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা- এর একটা সমন্বয় দরকার।”

দালালদের ফাঁদে পা দিয়ে বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “কিছু লোক জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা করে। তাদের মাধ্যমে চলে যায়। কোথায় যাবে, কী করবে, কোন ধরনের কাজ করবে- তার কোনোই ঠিক ঠিকানাই ছিল না। তাদের কাজের কোনো নিশ্চায়তা ছিল না।

“চোখে রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে পাঠানো হত এবং পরবর্তীতে অনেক সময় তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হত। এ ধরনের নানান সমস্যায় আমাদের দেশের মানুষদের ভুগতে হয়েছে।

“আমরা সে জায়গা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চাই। সেজন্যই আমরা ইতিমধ্যে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি।”

তবে এখনো এই সংকটের অবসান ঘটেনি বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।

“এখনো কিছু মানুষ আছে- যারা তাদের ভালো বুঝতে পারে না। তাদের যখন মুখরোচক কথা বলা হয়, তখন তারা নিজেদের ভাগ্যের অন্বেষণে যাত্রা শুরু করে। তারপর নানা ধরনের বিপদে পড়ে। এই অবস্থাগুলো এখনো কিছুটা বিদ্যমান রয়েছে।”

সম্প্রতি ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পর সাগর থেকে  উদ্ধার  বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এতো দুর্যোগের ভিতরে মানুষ সাগর পাড়ি দিয়ে কেন যে যেতে চায়- এটাই আমার অবাক লাগে।”

বিদেশে পাঠানোর নাম করে প্রতারণা ঠেকাতে আরো সতর্কতা ও নজরদারির তাগাদা দিয়ে তিনি বলেন, “কেউ যেন এই সাধারণ মানুষগুলোকে এক্সপ্লয়েট করতে না পারে- সেদিকে একটু নজর দেন।”

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী কর্মী আইন-২০১৩ এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বেড়েছে। প্রবাসী কর্মীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে।

প্রবাসী কর্মীদের সমস্যার সমাধান ও কাজের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন মিশন খোলা এবং ১৫টি নতুন শ্রম উইং চালু করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ কর্মীর ‘তথ্যভাণ্ডার’ প্রস্তুত এবং বিদেশগামী প্রত্যেক কর্মীর ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ বায়োমেট্রিক ‘স্মার্টকার্ড’ প্রচলনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সবাই যে খুশী হবে- তা নয়। কিছু লোক তো অখুশী হবে। তারা আমার কাছেও এসেছে। আমি তাদের বলেছি, ব্যবসা আমরা বন্ধ করতে চাই না। ব্যবসা চলবে। ব্যবসার নামে তারা সাধারণ মানুষকে এক্সপ্লয়েট করবে-সেটা যেন না হয়।

“সবাই ব্যবসা করে লাভ করতে চায়। কিন্তু  সে লাভেরও একটা সীমিত অংশ থাকা উচিত। কয়েকশ ভাগ লাভ করে গরীব মানুষগুলোকে নিঃস্ব করে দেওয়া- এটা যেন না হয়।”

জি-টু-জি পদ্ধতিতে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোয় মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন,  “এখন অতি অল্প খরচে মানুষ যেতে পারছে।”

বর্তমান সরকারের সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি লাভ করেছে।”

মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধ করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়াতে এক লাখ ৬৫ হাজার অবৈধ অভিবাসী ছিল। আমি তখন নিজে মালয়েশিয়া সফর করি এবং সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বৈধ করার একটা ব্যবস্থা করি এবং তারা বৈধ হয়। ঠিক একই অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিভিন্ন দেশে ছিল। আমরা আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যের ফলে সকলকেই বৈধ করে দেই।

“সাত বছর পর ক্ষমতায় এসে দেখলাম- মালয়েশিয়াতে দ্বিগুণ লোক অবৈধ হয়ে বসে আছে। একটা পর্যায়ে এমন ছিল, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ কথাটা তোলাই যেত না। নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার কথা তারা বলতেন। বিভিন্নভাবে কথা বলে আমাদের যারা অবৈধ ছিল তাদের বৈধ করি।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখন মালয়েশিয়ার সঙ্গে অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক। এখন আমরা জি টু জি বেসিসে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

বর্তমানে বিশ্বের ১৫৯টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যাদের যে দেশে পাঠাচ্ছি, সে দেশের মতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। যে দেশে যাবে, সে দেশের আইন কানুনগুলো জানা- এটা একান্তভাবে প্রয়োজন।”

বিদেশে যেখানে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন, সেখানে স্কুল করে দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রধানমন্ত্রীর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।