নির্যাতন ঠেকাতে আইন দাবি

দিনমজুর বা ভ্যানচালক বাবার আয়ে চলে না সংসার, বিধবা মায়ের পক্ষে দুবেলা দুমুঠো ভাত যোগাড়ই দুষ্কর-এ রকম পরিস্থিতিতে শহরে বাসার কাজে আসে শিশুরা। দিনরাত সবটুকু দিয়ে খাটলেও নির্যাতন হয় অনেকের নিত্যসঙ্গী; অনেক সময় জোটে না পেটপুরে তিনবেলা খাবার।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2014, 02:41 PM
Updated : 24 Nov 2014, 02:08 PM

সরকারি হিসাবে সারা দেশে এক লাখ ২৫ হাজারের মতো শিশু গৃহকর্মে নিয়োজিত রয়েছে।

প্রায় প্রতিদিনিই পত্রিকার পাতায় শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর এলেও এখনো তাদের সুরক্ষায় কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। সরকারি নীতিতে তাদের শ্রমকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ও বিবেচনা করা হয়নি।

সম্প্রতি ‘গার্ল ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স ভয়েজ ক্যাম্পেইন’ এর ব্যানারে করা একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র।

সমীক্ষায় রাজধানী ঢাকার বাসা-বাড়িতে কর্মরত ৭০টি মেয়ে শিশুর সাক্ষাৎকার নেয়া নেয়া হয়।

যেসব গৃহপরিচারিকা মালিকের ‘উদারতা’র সুবাদে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসার সুযোগ পায়, তাদের সাক্ষাৎকার ও পত্রিকায়

প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে চালানো হয় এই সমীক্ষা।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, “আপনজনদের থেকে দূরে থাকা এই শিশুদের চলাফেরার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে ‍গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর হাতে। অনেক সময় সামান্য অপরাধে পেতে হয় বড় শাস্তি।

“কন্যাশিশু শ্রমিকদের ওপর কেবল উচ্চমাত্রার দৈহিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোই পত্রিকায় স্থান পায়। ২০১৩ সালের অগাস্ট থেকে ২০১৪ সালের অগাস্ট পর্যন্ত এক বছরে সংঘটিত ৩৮টি নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে ৫০ শতাংশ ঘটনায় পুলিশ নির্যাতনকারীদের আটক করেছে। সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার পাঁচটিকেই আত্মহত্যা বলে দাবি করেছে গৃহকর্তারা,” প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে বলা হয় ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, সাক্ষাৎকার দেওয়া ৭০ শিশু গৃহকর্মীর মধ্যে ৫৬ শতাংশই ‘মালিকের’ কাছে মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছে। এছাড়া ২০ শতাংশ দৈহিক নির্যাতন এবং সাত শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানায়।

শিশু গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনার চার বছর পেরিয়ে গেলেও এর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো এখনো উপেক্ষিত রয়েছে। ‘জাতীয়  শিশুনীতি-২০১১’ এ শিশু গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় যেসব নির্দেশনা রয়েছে বাস্তবে তার প্রয়োগ কমই লক্ষ্য করা যায়।

সারা দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী এক লাখ ২৫ হাজার শিশু গৃহকর্মে নিয়োজিত বলে ২০১০ সালে করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে। তবে বিবিএস ও ইউনিসেফ-এর জরিপে (২০০৬) এই সংখ্যা প্রায় চার লাখ।

শিশু গৃহকর্মীদের অধিকাংশই কন্যাশিশু, যারা অভাব আর অসহায়ত্বের কারণে বাবা-মা ছেড়ে বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যায়।

শিশু গৃহকর্মীদের মানসিক নির্যাতন, মারধর, গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, বাসায় আটকে রাখা, পাচার, যৌন নির্যাতন এমনকি হত্যার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে বলে শাপলা নীড়ের প্রতিবেদনে বলা হয়।

অন্যের বাড়িতে ‘ক্রীতদাসের’ মতো একটানা কাজ করলেও তাদের জন্য নির্ধারিত কোনো শ্রমমূল্য নেই।

গত বছর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ৩৮টি পেশাকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলা হলেও গৃহশ্রমকে এর আওতায় রাখেনি সরকার।

২০১০ সালে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে শিশু গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় বেশ কিছু নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত।

বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের দেওয়া নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের গৃহকাজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।’

এছাড়া ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী গৃহকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, মাসে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তাদের কর্মঘণ্টা, ছুটি, বিশ্রাম, বিনোদন, বেতন নির্ধারণ ও নির্যাতিত শিশুদের মামলায় সরকারকে বাদী হতে নির্দেশ দেয় আদালত।

গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি ময়লার স্তূপ থেকে আদুরি (১১) নামের এক গৃহকর্মীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনার পর গৃহকর্মী শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে নতুন করে সোচ্চার হয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আদুরির চিকিৎসায় এগিয়ে আসে সরকারও।

নীতিমালা

শিশু গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকার কথা স্বীকার করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নুও।

অবশ্য গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে তিনি বলেছেন, সরকার গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সুরক্ষায় একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এই নীতিমালা প্রণয়ন সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন চুন্নু।

“এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় চলছে। এই নীতিমালা গৃহশ্রমিকদের জন্য আইন প্রণয়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।

সরকার এ উদ্যোগ নিলে তা খুবই ইতিবাচক হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাপানভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা শাপলা নীড়ের অ্যাডভোকেসি কর্মকর্তা আতিকা বিনতে বাকী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের আর্থ-সামাজিক কারণে শিশুদের বাসা-বাড়িতে কাজ বন্ধ করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে সরকারের উচিৎ তাদের প্রশিক্ষণ ও মৌলিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।”

শিশুশ্রমিকদের সুরক্ষায় বিশেষ পর্যবেক্ষক দল গঠনেরও দাবি জানান এই শিশু অধিকারকর্মী।