শামারুখের মৃত্যু: কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ

চিকিৎসক শামারুখ মাহজাবিন শ্যামার ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একটি ডায়েরি, বাবার সঙ্গে মৃত্যুর আগের দিন শামারুখের মোবাইলে কথোপকথনসহ আরও কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে চলছে তদন্ত।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2014, 08:42 AM
Updated : 21 Nov 2014, 08:42 AM

পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে তারা নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারবেন।

অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা। তাদের সন্দেহ, ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন সাবেক সংসদ সদস্য।

শামারুখ সাবেক সাংসদ খান টিপু সুলতানের পুত্রবধূ ছিলেন। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় রিমান্ড শেষে তার স্বামী হুমায়ূন সুলতানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তবে খান টিপু সুলতান ও তার স্ত্রী জেসমিন আরা বেগম জামিনে রয়েছেন।

গত ১৩ নভেম্বর শামারুখের রহস্যজনক মৃত্যুর পর তার বাবা নুরুল ইসলামের করা হত্যা মামলায় এই তিন জনই আসামি।

মামলার অগ্রগতির বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা কাজী শরিফুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভাইজান, মামলার তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমরা মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি।”

তাছাড়া শ্যামার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে তার শ্বশুর বাড়িতে পাওয়া একটি ডায়েরির কিছু লেখা পরীক্ষা, শ্যামার সঙ্গে তার বাবার মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সংগ্রহের চেষ্টায় আছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার ধানমণ্ডির বাসায় টিপু সুলতান ও তার স্ত্রী জেসমিন আরা বেগম ছাড়াও বাড়ির গৃহকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

তবে পুলিশ কী জানতে পেরেছে সে বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা পোষণ করেন পুলিশ কর্মকর্তা কাজী শরিফুল ইসলাম।   

এদিকে শামারুখের বাবা নুরুল ইসলাম ও বড় ভাই শাহানুর শরীফ অভিযোগ করেছেন হত্যা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন টিপু সুলতান।

শামারুখের বাবা নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “তার মৃত্যুর পর থেকে আমরা ভয়ে আছি। টিপু সুলতান আমাদেরকেও মেরে ফেলতে পারেন। তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমরা।”

সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ওইদিন শামারুখের শ্বশুর ফোন করে জানিয়েছিল সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাৎক্ষণিক ঢাকায় থাকা এক আত্নীয়কে ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালে পাঠানো হলে তিনি শ্যামার মৃত্যুর খবর দেন।

“বিয়ের পর থেকে আমার মেয়ে ধানমণ্ডিতে শ্বশুর বাড়িতে থাকতো। যেখান থেকে পায়ে হেঁটে সেন্ট্রাল হাসপাতাল আসতে কয়েক মিনিট লাগে। তার শাশুড়ি জেসমিন আরা বেগম হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক।

“সেইদিন বিকেলের পর জেসমিন বাসার বাথরুমের দরজা ভেঙে তার শাশুড়ি যদি দেখেই থাকেন শামারুখ আত্নহত্যা করেছে তাহলে কেন তিনি তখনই ঘটনাটি পুলিশকে না জানিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে পাঠালেন”, প্রশ্ন করেন নরুল ইসলাম।

শামারুখের শ্বশুর বাড়ির লোকজন ওই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে দাবি করে আসছেন।

নুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেনি, কোনো আলামতও সংগ্রহ করেনি। এমনকি কোনো গণমাধ্যম কর্মীও চেষ্টা করে সেই বাসায় প্রবেশ করতে পারেনি।

শামারুখের ভাই শাহানুর শরীফ জানান, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ধানমণ্ডি থানা পুলিশের এক উপ পরিদর্শক তার বোনোর সুরতহাল প্রতিবেদন করতে গেলে টিপু সুলতান সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে ধমক দিয়ে সুরৎহাল প্রতিবেদনে আত্মহত্যার কথা লিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সে অনুযায়ী সুরতহাল প্রতিবেদন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, “সুরতহাল প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্য কীভাবে আসে? কারণ যতদূর জানি সুরতহাল প্রতিবেদন মানে লাশ কোন অবস্থায় পাওয়া গেছে, লাশের শরীরে কোনো ধরনের ক্ষতচিহ্ন আছে কিনা- এসব বিষয় থাকবে।”

শামারুখের পরিবারের সদস্যরা জানান, তারা মামলা করার আগেই থানায় টিপু সুলতান ও তার ছেলে হুমায়ূন সুলতান উপস্থিত ছিলেন। হত্যা মামলা করার পর হুমায়ূন আটক হলেও টিপু ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

শাহানুর শরীফ দাবি করেন “শামারুখ খুব স্পষ্টভাষী মেয়ে ছিল। কারো অন্যায় সহ্য করতে পারতো না। টিপু সুলতানের অপকর্মের কিছু দলিল তার হাতে এসেছিল। মৃত্যুর আগের দিন দুপুরে সে এই বিষয়ে মোবাইলে বাবাকে জানিয়েছিল।”

সেটিই ‘কাল হয়েছে’ বলে পরিবারের ধারণা।

এক প্রশ্নের জবাবে শাহানুর বলেন, “প্রায় দুই বছর আগে আমার মায়ের মৃত্যুর পর আব্বা ভেঙে পড়েছিলেন। শামারুখ আব্বাকে সান্ত্বনা দিত। কিন্তু আমরা ওর শ্বশুর বাড়িতে যেতাম না।”

বিভিন্ন অজুহাতে টিপু সুলতান শামারুখের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন বলেও অভিযোগ করেন শাহানুর শরীফ।

“গত ঈদের আগে টিপু সুলতান ফোন করে বাবাকে জানায় তারা নতুন বাসা নিয়েছেন। তার অবর্তমানে সেখানে শামারুখ ও তার স্বামীই তো থাকবেন; তার কাছে টাকা নেই। পরে বাবা তাদের বাসায় ফার্নিচার কিনতে আড়াই লাখ টাকা দেন।”

সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর এসেছে শামারুখের একটি ডায়েরি পেয়েছে পুলিশ। তবে বিষয়টি ‘সাজানো’ বলে দাবি করেন শাহানুর।

তিনি জানতে চান, একটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে শ্যামার শ্বশুর বাড়ি থেকে পুলিশ একটি ডায়েরি পেয়েছে। সেটি এতদিন তো পুলিশ আমাদের জানায়নি। তাহলে কেন এখন ডায়েরি পাওয়ার কথা সাজানো হচ্ছে?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, “যেখান থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে পুলিশ সেখানে যেতে পারেনি। তার আগেই মৃত্যুর আলামত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।”

পুলিশকে কেউ প্রভাবিত করছে না দাবি করে তিনি বলেন, “সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তার আত্নীয়রা দাবি করেছে আত্মহত্যায় মেয়েটি মারা গেছে। তার কথা সত্য কিনা তা জানতেই লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “লাশটি দেখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার কোনো ঘটনা মনে হয়নি। শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। তাই লাশটি ময়নাতদন্তে দেওয়া হয়েছে।”

উদ্ধারকৃত ডায়েরিতেও আত্মহত্যার কোন কথা লেখা ছিল না বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

শরিফুল ইসলাম বলেন, “শামারুখ ও তার বাবার মোবাইলের কথোপকথনের রেকর্ড পাওয়ার জন্য খুব শিগগির সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন কোম্পানির সহযোগিতা চাওয়া হবে।”