১৫ তম মৃত্যুদিবসে সুফিয়া কামালকে স্মরণ

‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণে’র স্লোগানকে সামনে রেখে পালিত হয়েছে কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2014, 07:01 PM
Updated : 20 Nov 2014, 07:01 PM
কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে বৃহস্পতিবার রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

বিকাল ৩টায় মহিলা পরিষদসহ ৬৮ টি সংগঠনের উদ্যোগে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভাও।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লবি বিভাগের পরিচালক জনা গোস্বামী এ প্রসঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেগম সুফিয়া কামাল শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। তার এবারের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তার এই পরিচয়টিকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি।”

তিনি বলেন,“ এবারে আমাদের স্লোগান ছিলো-নারী নির্যাতন প্রতিরোধে চাই পুরুষ ও তরুন সমাজের সক্রিয় ভূমিকা। বক্তারা এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই বক্তব্য দিয়েছেন।”

আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন কবির কন্যা এবং বাংলাদেশ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, ব্র্যাকের জেন্ডার স্টাডিজ এর পরিচালক শিখা হাফিজা, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির, দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইউম, দৈনিক কালের কণ্ঠের সহযোগী সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত প্রমুখ।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। বাবা আব্দুল বারি ছিলেন পেশায় আইনজীবী। সাত বছর বয়সে সুফিয়া কামালের বাবা দরবেশ হয়ে নিরুদ্দেশ হন।

কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না এই কবি। রক্ষণশীল পরিবেশে বাস করেও তিনি হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত।

বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন সুফিয়া। পর্দার ঘেরাটপ থেকে বেরিয়ে হয়ে ওঠেন আধুনিক মানুষ।

১৯১৮ সালে মা এর সঙ্গে কোলকাতায় যান তিনি। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সান্নিধ্যে আসেন।

ছোটবেলা থেকেই পত্র-পত্রিকা ও বই পড়ার আগ্রহ থেকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তার লেখা প্রথম গল্প 'সৈনিক বধূ' বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

ওই বছরেই মাত্র বারো বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি জাঁকজমকপূর্ণ মুঘল পোশাক বর্জন করে সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরা শুরু করেন।

১৯২৫ সালে বরিশালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তারও আগে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি চরকায় সুতাও কাটেন।

বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সুফিয়া কলকাতা যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে জড়িত হন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুফিয়া কামালের 'সাঁঝের মায়া' কাব্যগ্রন্থ পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে আশীর্বাণী পাঠান।

এর মাধ্যমেই সুফিয়ার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন।

১৯২৯ সালে তিনি বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত মুসলিম মহিলা সংগঠন 'আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম'-এ যোগ দেন। ১৯৩১ সালে তিনি মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম 'ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন'-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৩২ সালে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ১৯৩৩-১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ান। পরের বছর তিনি কলকাতায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন।

১৯৪৭ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন। এ সময় সুফিয়া সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন।

তিনি ছায়ানট, কচিকাঁচার মেলা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তার দুই মেয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), একাত্তরের ডায়েরী, মোর যাদুদের সমাধি পরে, একালে আমাদের কাল, মায়া কাজল (১৯৫১), কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) ইত্যাদি। ২০০২ সালে বাংলা একডেমী সুফিয়া কামালের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে।

সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কার 'তঘমা-ই-ইমতিয়াজ' লাভ করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলা একডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস ক্রেস্ট (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) লাভ করেন।

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ৮৮ বছর বয়সে ঢাকায় তার জীবনাবসান ঘটে।