ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৌমিন শাহরিদ জেভিন বলেছেন, “আমিও তো বাবার মতাদর্শী ও একই ভাবধারার লোক। আমি আসলেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, আসলেই নিরাপত্তহীনতায় ভুগছি।”
“পুরো জাতির ওপর আমার আকুল আবেদন এই এতিমের কথা ফেলে দেবেন না- এটা আমি হাত জোড় করে বলছি।”
নিহত অধ্যাপককে স্মরণে বৃহস্পতিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত স্মরণ সভায় নিজের কথাগুলো বলেন জেভিন।
সমাজ বিজ্ঞানের শফিউল ইসলাম লিলন দুই বছর আগে লালনভক্ত হয়ে ওঠেন, তার পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে তার জীবনাচরণেও এর প্রভাব পড়ে।
ক্যাম্পাস সংলগ্ন চৌদ্দপাইয়ের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে লালনের গানের আসরও বসাতেন শফিউল। ওই বাড়ির সামনেই গত ১৫ নভেম্বর দুপুরের পর তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
হত্যাকাণ্ডের জন্য জঙ্গিদের দায়ী করে জেভিন বলেন, “এটা সম্পূর্ণ জঙ্গি হামলা, মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন আমার বাবা।”
সরকার ও পুলিশের ওপর নিজের আস্থার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে। আর কোনো শিক্ষককে যেন খুন হতে না হয়।
স্মরণ সভায় অধ্যাপক শফিউলের ছোট বোন ওয়াসিম রুমানা লিপি বলেন, “একাত্তরের ঘাতকরা এখনও আছে। আমরা কথা বলতে চাই, আমাদের কথা বলতে দেওয়া হোক। কিন্তু কথা বললেই তো টার্গেট হয়ে যাব।”
খুনিদের গ্রেপ্তার এবং বিচার দাবিতে আন্দোলন যেন থেমে না যায়, সে জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ রাখেন তিনি।
নিহতের ছেলে জেভিন বলেন, “আজ আমি পিতৃহারা, আপনার পরিবারে এমন শোকের দিন যেন না আসে, তাই জাগ্রত হোন, কথা বলতে শিখুন, সত্য পথে চলুন।”
স্মরণ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেন জেভিন, এই সময় তার বাবার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
জেভিন বলেন, “আমি কখনও চাইনি কালো ব্যানারে আমার বাবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ থাকুক। এই শোক আয়োজনে আমাকেও কথা বলতে হবে।”
“যিনি চলে গেছেন তিনি শুধু আমার বাবাই নয়, তিনি ছিলেন আমার সব থেকে ভালো বন্ধু,” বলেন অকালে মাকে হারানোর পর এখন বাবাকেও হারিয়ে ফেলা এই তরুণ।
ঢাকায় থাকা জেভিন গত ৪ নভেম্বর সর্বশেষ রাজশাহীতে এসেছিলেন, সেটাই ছিল বাবার সঙ্গে তার শেষ দেখা।
১৫ নভেম্বর ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত শফিউলকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন বাবার মোবাইলে কল করেছিলেন বলে নিজের ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন জেভিন।
“কানে ভাসছে তোমার সেই আর্তচিৎকার। তোমাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমার কলটা কেন ধরলে বাবা? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আমি বড় অসহায়।”
হাসপাতালে নেওয়ার পরও শফিউল নিজের মোবাইল ফোনটি শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন বলে তার সহকর্মীরা ইতোপূর্বে জানিয়েছিলেন।
জেভিন স্মরণ সভায় বলেন, “একদিন ছুটি পেলেই রাজশাহীতে চলে আসতাম। যাওয়ার সময় বাবা জড়িয়ে ধরে বিদায় দিতেন, চুমু খেতেন। বাবা বলতেন, ‘ভালোবাসা দিয়েই পৃথিবীর সব হয়’।”
স্মরণসভায় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু তাহের বলেন, “শেষ ক্লাসেও স্যার (শফিউল) বলেছেন, সত্য বল সুপথে চল।”
রাজশাহীর ভাড়া বাড়িতে অধ্যাপক শফিউল যেসব কাজ একা একা করতেন, তার স্মৃতিচারণও করেন জেভিন।
“বাবার কোমরে, কিডনিতে সমস্যা ছিল, তাই পা দিয়ে ঘর মুছত। আমি সাহায্য করতে চাইলেও নিত না।”
জেভিন ফেইসবুকে লিখেছেন, “বুকটা ফেটে যায় যখনই মনে হয় ওই দৃশ্যটা- যে আমার ঘুম ভাঙল আর দেখি বাপ আমার ঘর ঝাড় দিচ্ছে আর বলছে, ‘আব্বা উঠেন নাস্তা রেডি করেছি, ১১টায় ক্লাস আছে’।”
“কেন তাকে নৃশংসভাবে মারা হল, এর উত্তর আমি পাই না। কেন এত রক্তক্ষরণ হল? বাবা বলতেন যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয় ১০০ বছর বাঁচব, অথচ ৫০ বছর বয়সেই মারা গেলেন তিনি,” স্মরণ সভায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন জেভিন।
“আমার কেউ নেই, মা নেই বাবা নেই আমি এতিম। আমি কী নিয়ে বাঁচব? বাঁচাটাই এখন বড় শাস্তি,” কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায় অধ্যাপকপুত্রের।
এর আগে শফিউলকে হত্যার হুমকি দিয়ে তার বাড়িতে কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
জেভিন বলেন, “বাবা মনে করত, তাকে সবাই ভালোবাসে, হুমকি শুধুই হুমকি, তাকে কিছুই করবে না।”
অধ্যাপক শফিউলের মা সখিনা আক্তার অনুষ্ঠানস্থলে এসেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। শফিউলের দুই বোনসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফয়জার রহমান বলেন, জরাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন শফিউল। অথচ তার জীবনই থেমে গেল।
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও শফিউলের ছাত্র নাজমুল হক কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিন, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিলুফার সুলতানা, অধ্যাপক আব্দুর রহমান সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক সভায় বক্তব্য দেন।
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীও শফিউলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে জেভিনের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শোকবার্তা তুলে দেন উপাচার্য।
শিবির সভাপতিকে গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম
অধ্যাপক শফিউল হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সংগঠনটির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আশরাফুল ইসলাম ইমনকে গ্রেপ্তারে পুলিশকে সময় বেঁধে দিয়েছে ছাত্রলীগ।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন শেষে এক সমাবেশ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, “জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।”
ইমনকে গ্রেপ্তারে প্রশাসন ব্যর্থ হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক আহমদ আলী মোল্লা অভিযোগ করেন, “জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়ে পুলিশ তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অপরাধ করার সুযোগ করে দিচ্ছে।”
একদিন আগে পুলিশ বলেছিল, ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ জঙ্গিরাই অধ্যাপক শফিউলকে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাদের মনে হয়েছে।