লেদ মেশিনে নিষ্পেষিত হাজারো শৈশব

নিয়ম বলে, ওদের এখন বিদ্যালয়ে থাকার কথা, শেখার কথা লেখাপড়া। কিন্তু তার বদলে পুরান ঢাকার অলিগলিতে লেদ মেশিনে বেগার খাটছে কয়েক হাজার শিশু কিশোর।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2014, 03:57 AM
Updated : 20 Nov 2014, 10:39 AM

পুরান ঢাকার এসব কারখানা শিশু-কিশোরের শ্রম শুষে নিচ্ছে এক কথায় প্রায় বিনা পয়সায়। মালিক দিচ্ছেন কেবল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। তিনি খুশি থাকলে সপ্তাহান্তে দু’একশ টাকা চেয়ে নেওয়া যায়, তবে সেটাও ধরা বাঁধা কিছু নয়। 

তারা জানে, এই বয়সে বেতন পাওয়া যায় না; এটা ‘উস্তাদের’ কাছে কাজ শেখার বয়স।

অথচ জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারও ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বিবেচনা করে। সরকারের নীতিমালায় যেসব কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে, লেদ কারখানার কাজ তার একটি।

বাংলাদেশ ইস্পাত ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক সমিতির দপ্তর সচিব মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দেশে ৪০ হাজারেরও বেশি ইস্পাত কারখানা রয়েছে, যেখানে দেশীয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ধাতব অংশ এবং ইঞ্জিনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়।

কেবল ঢাকা শহরেই ছোট-বড় ১০ হাজার ইস্পাত কারখানা রয়েছে, যাতে ৫০ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করছে বলে ধারণা দেন মোশাররফ।

অধিকাংশ কারখানাতেই শিশুকিশোরদের লেদ সহকারী হিসাবে খাটানো হলেও তাদের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি মোশাররফ। তবে এই সংখ্যা ২০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে কারখানা সংশ্লিষ্টদের ধারণা। 

রাজধানীর টিপু সুলতান রোড কিংবা ধোলাই খাল এলাকার লেদ কারখানাগুলোতে এই শিশু কারিগরদের কাজ শুরু হয় সকাল ৯টায়। ইস্পাত খণ্ডের কাঙ্ক্ষিত আকৃতি দিয়ে ছুটি মিলতে মিলতে রাত ৯টা পেরিয়ে যায়।

বুধবার এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কের দুই ধারে এবং দুই দিকের সরু অলিগলিতে রয়েছে কয়েক হাজার লেদ ওয়ার্কশপ। প্রতিটি ওয়ার্কশপে কাজ করছেন ছোট-বড় ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক।

কালিঝুলি মাখা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে আধো অন্ধকারে এসব কারখানায় বড়দের পাশাপাশি কাজ করছে শিশুরাও। লেদ ছাড়াও লোহা কাটা, ওয়েল্ডিং ও ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ পরিষ্কারের কাজ করানো হচ্ছে তাদের দিয়ে।

৭ বছরের আরিফ থেকে শুরু করে ১৫ বছর বয়সী রাকিব- এই শিশুদের অধিকাংশই ঢাকার অদূরের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে পুরান ঢাকায় জড়ো হয়েছে বিভিন্ন কারণে। তাদের কেউ কেউ বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে, তবে বেশিরভাগের পরিবারেই রয়েছে অভাবের ইতিহাস।    

সাভার থেকে আসা আরিফ, নেয়ামত আর নবাবপুর এলাকায় জন্ম হওয়া সুমনসহ এই শিশু শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এসব কারখানায় প্রথম দিকে বেতন পাওয়া যায় না, অন্তত এমনটিই তাদের বলা হয়েছে।

ধোলাইখালের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা পায় ১৬ বছরের কবীর; নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে নিয়মিত বাকিটা পাঠায় চাঁদপুরে মায়ের সংসারে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বছর দুই আগে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার নবাবপুরে এসে লেদ কারখানায় কাজ শুরু করে রাকিব।

তার ভাষায়, “কাজ শেখা না হইলে এইখানে বেতনের সিস্টেম নাই। উস্তাদের কাছে কাজ শিখি। নির্দিষ্ট কোনো বেতন নাই। খরচের জন্য চাইলে দুই একশ ট্যাকা দেয়।”

টিপু সুলতান রোডে প্রায় ২৫ বছর ধরে লেদ মেশিনের কাজ করছেন ষাটোর্ধ্ব শ্রীকান্ত রায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সচল থাকে নবাবপুর ও টিপু সুলতান সড়কের লেদ ওয়ার্কশপগুলো। মাঝখানে পালা করে কাজে বিরতি দিয়ে খাওয়া ও বিশ্রাম।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রম মন্ত্রণালয় যে ৩৮টি কাজকে শিশুদের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে লেদ মেশিনের শ্রম তার অন্যতম। দেশে এখনো প্রায় ৩২ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত।”

সরকার নীতিমালা করলেও তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার নিয়ে মালিকদের মাথাব্যথা নেই খুব একটা।

ইস্পাত ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক সমিতির মোশাররফ হোসেনের দাবি, ‘লেখাপড়ায় অমনোযোগী শিশুরাই’ এ ধরনের কাজে আসে। অনেক সময় অভিভাবকরাই ‘সচেতনভাবে’ তাদের সন্তানকে পাঠায়।