বিচার পেল বিধবাপল্লী

একাত্তরে আলবদর নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পরিকল্পনায় ১২০ জন পুরুষকে হত্যা ও বহু নারীকে ধর্ষণের মধ্য দিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামকে পরিণত করা হয় বিধবাপল্লীতে; সেই অপরাধেরই চূড়ান্ত রায়ে এ জামায়াত নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2014, 02:10 PM
Updated : 3 Nov 2014, 06:13 PM

বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চের বাকি সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের আপিল বিবেচনা করে দণ্ড বহাল রাখারই সিদ্ধান্ত দেয় আদালত। 

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ জুন। এরপর গত বছর ৯ মে হত্যা ও  নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ওই রায়ে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ হয়। ১ ও ৭ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল ।

আপিল বিভাগের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডে কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন চার বিচারক। তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। তবে কোন বিচারক ভিন্ন সাজার পক্ষে বলেছেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে তা জানা যায়নি।

অভিযোগ ৩: একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের মহিলারা। ওই ঘটনার পর সোহাগপুর পরিচিত হয় ‘বিধবাপল্লী’ নামে।

আপিলের রায়ে চার নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

তবে তিন নম্বর অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় এই জামায়াত নেতার ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ডই প্রযোজ্য হচ্ছে। 

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২৩ অগাস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে ভাতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ওই রাতে গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হন, হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান আবুল কাশেম।

 

এছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন সাজা আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বহাল রেখেছে।

অভিযোগ ৭: একাত্তরে ২৭ রোজার দিন দুপুরে টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়ার ছেলেসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ২ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানের ১০ বছর কারাদণ্ডও বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।

অভিযোগ ২: একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা।

প্রসিকিউশনের ১ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ থাকে খালাস দিয়েছে। 

অভিযোগ ১: কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একাত্তর সালের ২৯ জুন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।এরপর তাকে নির্যাতন করে আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে জানানো হয়েছিল। প্রসিকিউশনের আপিল না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। 

অভিযোগ ৫: একাত্তরে রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় শেরপুরের চকবাজারের বাসা থেকে মো. লিয়াকত আলী ও আরো ১১ জনকে আটক করে ঝিনাইগাতী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তিনজন ছাড়া বাকি সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার সময় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ করে প্রসিকিউশন।

অভিযোগ ৬: একাত্তরের নভেম্বর মাসে দিদারসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহ শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে সেখানে নির্যাতনে হত্যা করা হয় তাদের। এ ঘটনায় কামারুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। 

১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা  কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে। ১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন।

১৯৯২ সাল থেকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে  থাকা কামারুজ্জামানকে ২০১০ সালের ২৯ জুলাই গ্রেপ্তারের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গতবছর ৯ মে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর থেকেই তিনি কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর চল্লিশ নম্বর ফাঁসির সেলে রয়েছেন।