চট্টগ্রামের বদর কমান্ডার মীর কাসেমের প্রাণদণ্ড

একাত্তরে যার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে নৃশংসতা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল আলবদর রাজাকার ও আলশামস বাহিনী, স্বাধীন বাংলাদেশে যার যোগানো অর্থে জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে শক্ত ভিত্তি, সেই মীর কাসেম আলীকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

সুলাইমান নিলয় কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2014, 05:39 AM
Updated : 2 Nov 2014, 05:39 AM

যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রোববার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় দেন।

যুদ্ধাপরাধে জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের তিন দিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটির হরতালের মধ্যেই এ রায় এলো।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার এই সদস্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ আটজনকে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে।

এর মধ্যে একটি অভিযোগে তিন বিচারক সর্বসম্মতভাবে এবং অন্যটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। 

এছাড়া অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আটটি অভিযোগে মীর কাসেমকে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়ার সময় হালকা আকাশী শার্ট ও ঘিয়ে কোট পরিহিত মীর কাসেমকে শুরুতে কাঠগড়ায় বসে দৃশ্যত ফুরফুরে মেজাজে হাঁটুর ওপর আঙুল নাচাতে দেখা যায়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে।

ফাঁসির সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বলে ওঠেন, “শয়তান.. শয়তান..।

“মিথ্যা ঘটনা... মিথ্যা সাক্ষ্য... কালো আইন... ফরমায়েশি রায়। সত্যের বিজয় হবে শীঘ্রই... শীঘ্রই।”

প্রসিকিউশন ৬২ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।

জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। ব্যাপক যুদ্ধাপরাধে অংশ নেওয়া আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন তিনি।

একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে।

রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে। কোথাও কোথাও আনন্দ মিছিলও হয়।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কাসেমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, এই রায়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তারা আপিল করবেন।

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, এই বিচারের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির আরেকটি ধাপ পেরোলো জাতি।

এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা,  নিহতদের স্বজন ও সাক্ষীরাও ।

ডালিম হোটেলে নির্যাতনে নিহত মুক্তিযোদ্ধা জাসিমের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাজীব হুমায়ুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি একাত্তর সাল থেকে কাঁদছি আমার ছোট ভাইয়ের জন্যে। ফাঁসি হলে পরে আমার কান্নাটা কমবে। আমি আল্লাহর কাছে শোকর করলাম। এখন যেন ফাঁসি কার্যকর হয়, সেজন্যে প্রার্থনাও করলাম।”

ফাঁসি দুই অভিযোগে

মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ আটজনকে হত্যার দুটি ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে।

এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার পর তার এবং আরো পাঁচজনের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

আর ১২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রঞ্জিত দাস ওরফে লাঠুকে ও টুনটু সেন ওরফে রাজুকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরে জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে দেওয়া হলেও লাঠু ও রাজুকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়।

১১ নম্বর অভিযোগে তিন বিচারক কাসেমকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজার রায় দেয়। তবে ১২ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে এক বিচারক আসামিকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়ায় ফাঁসির রায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।

ট্রাইব্যুনালের আগের দশটি রায় সর্বসম্মতভাবে এলেও মীর কাসেমের রায়ে এসে প্রথমবারের মতো কোনো বিচারক বাকি সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত পোষণ করলেন।

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগের সবগুলোতেই অপহরণ করে নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেমকে ২০ বছর কারাদণ্ড, ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং বাকি ছয় অভিযোগের প্রতিটিতে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

তবে দুটি অপরাধে ফাঁসির রায় আসায় তার ক্ষেত্রে আর কারাদণ্ডের বিষয়টি কার্যকর হবে না। 

ট্রাইব্যুনাল রায়ে জানিয়েছে, মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

‘ডেথ ফ্যাক্টরি’

মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে ভবনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হতো, সেই ডালিম হোটেলকে রায়ের পর্যাবেক্ষণে বলা হয়েছে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

তথ্যপ্রমাণ হিসাবে আসামিপক্ষের দাখিল করা ‘প্রামাণ্য দলিল: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে বিচারক বলেন, “আলবদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসতো আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যেই। এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদর সদস্যদের পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজে। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই ছিল একটি ‘মৃত্যুর কারখানা’।”

মীর কাসেমের বিরুদ্ধে প্রমাণিত সব অভিযোগেই ডালিম হোটেলের সেই নির্যাতন কেন্দ্রের বিবরণ এসেছে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে হাত-পা ভেঙে দেওয়া, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করার মদো বহু ঘটনার কথা উঠে এসেছে এ মামলার সাক্ষীদের মুখেও।

ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সবধরনের অপরাধের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন মীর কাসেম। এসব অপরাধে তার ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত। ফলে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী তিনি ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের’ দোষে দোষী।

প্রতিক্রিয়া

রায়ের পর কাসেমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “যে সকল প্রমাণাদির ভিত্তিতে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে এই রায় দেওয়া যায় না। প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, “আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে তৎকালীন জামায়াতের আমীর গোলাম আযমের নির্দেশে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মীর কাসেম মুক্তিযোদ্ধা ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন করেছে, যা মানবতা ও মানব ইতিহাসে অন্যতম অপরাধ। এই বিচারের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির আরেকটি ধাপ পেরোলো জাতি।”

যেসব অভিযোগে আসামিকে আদালত খালাস দিয়েছে, সেগুলোতে আপিল করা হবে কি-না, সে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে বলে জানান আরেক প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ।

মীর কাসেমের ফাঁসির রায় জানার সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ বিজয় মিছিল বের করে।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “প্রত্যাশিত রায় হয়েছে। পাশাপাশি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে হরতাল সমর্থনকারী জামায়াত-শিবির কোনো ধরনের নাশকতা করতে না পারে।”

রায়ের পর  তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “এখন আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে আজকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের (যুদ্ধাপরাধী) আমরা শাস্তি দিতে পারছি-এটা হচ্ছে বিরাট প্রাপ্তি।”

অন্যদিকে শুরা সদস্য মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার হরতাল ডেকেছে তার দল জামায়াতে ইসলামী।

জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ এক  বিবৃতিতে বলেন, “আদালত সরকারের দায়ের করা মিথ্যা মামলায়, সাজানো সাক্ষীর ভিত্তিতে আজ তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের যে রায় ঘোষণা করেছেন তা একটি ন্যায়ভ্রষ্ট রায়। এ রায়ে মীর কাশেম আলী ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।”

অন্যদিকে এ মামলার সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে রকম খুশি হয়েছিলাম, বদরপ্রধান মীর কাসেমের বিরুদ্ধে দেওয়া ফাঁসির রায়েও সেরকম খুশি হয়েছি।”

মানবতাবিরোধী অপরাধে আল-বদর নেতা মীর কাসেম আলীর ‘উচিত সাজা’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ।।

বদর নেতা থেকে জামায়াতের শুরা সদস্য

মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস কাসেম আলী রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ধূর্ততার স্বাক্ষর রেখে অত্যন্ত দ্রুততায় নিজের ও দলের উন্নতি ঘটিয়েছেন, পরিণত হয়েছেন জামায়াতের আর্থিক মেরুদণ্ডে।

জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এই যাত্রাপথে তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছেন।

মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামের তৈয়ব আলীর দ্বিতীয় ছেলে মীর কাসেম আলীর জন্ম ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার ডাকনাম পিয়ারু ও হলেও চট্টগ্রামের মানুষ তাকে চিনত মিন্টু নামে।

গত শতকের ষাটের দশকে কাসেম ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থী, ১৯৬৭ সালে ওই স্কুল থেকেই তিনি মেট্রিক পাশ করেন। বাবা তৈয়ব আলী ছিলেন চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার সিঅ্যান্ডবি কলোনিতে তারা থাকতেন।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর সেখানেই স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন কাসেম, পরের বছর জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কলেজ শাখার সভাপতি হন। স্বাধিকারের দাবিতে বাঙালির সংগ্রাম তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সারা দেশে বাঙালি নিধন শুরু করলে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অস্ত্র হাতে নেয় এ দেশের মানুষ। ওই বছর ৬ নভেম্বর পর্যন্ত কাসেম চট্টগ্রাম শহর শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন এবং সেই সূত্রে ছিলেন চট্টগ্রামে আর বদর বাহিনীর নেতা।

৭ নভেম্বর দলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক  হন। সে সময় সংগঠনের সভাপতি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী আরেক জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসাবে মীর কাসেম চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তিনি আত্মগোপনে যান। স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ছাত্রসংঘ ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি।

ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে ঢাকার আইডিয়াল কলেজ থেকে বিএ পাস করেন মীর কাসেম।

পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান জামায়াতকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাসেম তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।

১৯৮০ সালে কাসেম যখন সরাসরি জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেন রাবেতা আলম আল-ইসলামী নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ সমন্বয়ক। বলা হয়, সেই সময় থেকেই তিনি জামায়াতের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন হলে মীর কাসেম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান হন। দলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৫ সালে তিনি হন জামায়াতের শুরা সদস্য।

ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মীর কাসেম ছিলেন ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য ।

গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত মীর কাসেম দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন।

গতবছর ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মামলা বৃত্তান্ত

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করার পর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মীর কাসেমকে কারাগারে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গতবছর ১৬ মে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মীর কাসেমের যুদ্ধাপরাধের বিচার।

এরপর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানেই ১৮ নভেম্বর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্য দিয়ে শুরু হয় শুনানি।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে এবছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন। এরপর ২১ ও ২২ এপ্রিল মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিনসহ তিনজন।

সাক্ষ্য-জেরা এবং দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে চলতি বছর মে মাসে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

একাদশ রায়

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি ছিল একাদশ রায়।

এর আগের দশটি রায়ের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আর মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড, দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।

এর মধ্যে আপিলের রায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হলে গত  ১২ ডিসেম্বর তা কার্যকর করা হয়। আর সাঈদীর আপিলে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যেই গত ৩০ অগাস্ট ৮৩ বছর বয়সে মারা যান আলীম। ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি। আর রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু গোলাম আযম।

 

[এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কামাল তালুকদার, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, মইনুল হক চৌধুরী, সাজিদুল হক, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম, আশিক হোসেন, আজিজ হাসান, নাহিদ আশরাফী ও মহিউদ্দিন মুরাদ।]