বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে বাংলাদেশ

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ে শনিবার প্রায় আট ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল প্রায় গোটা বাংলাদেশ, যার ভোগান্তি ছিল সীমাহীন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2014, 07:04 PM
Updated : 1 Nov 2014, 10:02 PM

শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর ত্রুটি সারাতে দেরি হওয়ায় সন্ধ্যার পর পুরো দেশ ডুবে গিয়েছিল অন্ধকারে।

সন্ধ্যা নামার কয়েক ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ আসতে শুরু করে মধ্য রাতের দিকে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এলে জনদুর্ভোগের অবসান ঘটে।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার রামকৃষ্ণপুরে বাংলাদেশ-ভারত সঞ্চালন কেন্দ্রে ত্রুটি থেকে এই সমস্যার সূত্রপাত বলে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

তবে বিপর্যয়ের এটাই কারণ, তা এখনই সরাসরি বলতে নারাজ বিদ্যুৎ সচিবসহ কর্তাব্যক্তিরা। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কোনও ভুলও কারণ হতে পারে বলে সন্দেহ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ, কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সারাদেশ একসঙ্গে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ার পর নানা ধরনের গুজবও ছড়িয়ে পড়ে, নাশকতার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন কেউ কেউ। নাশকতার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও।

এর মধ্যেই নাটোরে জনসভায় বক্তৃতায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, টেলিভিশনে তার বক্তৃতার সরাসরি সম্প্রচার ঠেকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুর্ভোগে রোগীরা

বিদ্যুৎহীন এই সময়টাতে রাজধানীসহ সারাদেশ কার্যত্র অচল ছিল প্রায় আট ঘণ্টা। কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীদের পড়তে হয়ে দুর্ভোগে, নগরবাসীকে পড়তে হয় পানির ভোগান্তিতে।

সকালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশ ও ভারতের সরবরাহ লাইনে ত্রুটি থেকে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের খবরটি প্রথম পাওয়া যায়। পরে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার খবর আসতে থাকে।

ভেড়ামারার ওই সঞ্চালন লাইন দিয়ে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। 

কুষ্টিয়ার কর্মকর্তারা বলেন, ভেড়ামারার রামকৃষ্ণপুরে অবস্থিত ৫০০ মেগাওয়াট এইচভিডিসি ভারত-বাংলাদেশ ব্যাক টু ব্যাক বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্রে আকস্মিক বিপর্যয় ঘটে।

ব্যাক টু ব্যাক বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “বেলা ১১ টা ২৭ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের সময় হঠাৎ করে এ কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ব্ল্যাক আউট হয়।”

লো-ভোল্টেজ বা অন্য কোনও কারণে এই বিপর্যয় ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণার কথা জানান তিনি।

কুষ্টিয়ার সমস্যার পর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. মনিরুজ্জামান জানান, সকাল সাড়ে ১১টায় জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের পর থেকে চট্টগ্রামের কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

একই সময় আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নয়টি ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বলে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারিগরি বিভাগের পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান জানান।

এর মধ্যে ত্রুটি মেরামতের কাজ শুরু হয়। সাড়ে ১২টার দিকে পুনরায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়ে তা ৭০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ওঠেছিল বলে জানান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল।

ঢাকার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার চিত্র, যেন অন্ধকারের নগরী

কিন্তু এরপর বিকালে পুনরায় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দিলে ফের সঙ্কট দীর্ঘায়িত হয়ে যায়।

এদিন বিদ্যুতের ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট চাহিদা ছিল বাংলাদেশে। সরবরাহ ৭০০ মেগাওয়াটের ওঠার পর পুনরায় বিপর্যয় দেখা দিলে তা ২০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে বলে সন্ধ্যায় জানান বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার হোসেন।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সন্ধ্যায় বলেন, দ্রুত সরবরাহ বাড়াতে গিয়ে পুনরায় সমস্যা দেখা দেয়। এখন ধীরে ধীরে সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে।   

“আমরা দ্রুত রিকভারি করতে গিয়েছিলাম। ৭০০ পর্যন্ত (মেগাওয়াট) রিকভার করেছিলামও। এর মধ্যেই গ্রিড আবার ফেইল করে।”

“দ্রুত এগোনোয় সমস্যা হয়েছে। এখন আমরা স্লোলি (ধীরে) এগোচ্ছি,” গ্রাহকদের কাছে সময় চেয়ে বলেন তিনি।

বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে সময় লাগার কারণে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান সচিব মনোয়ার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অনেকগুলো এলাকা কভার করে ফেলেছিলাম। কিন্তু সিস্টেমটা আবার বিট্রে করেছে। আমরা সবাই আছি, কাজ করছি।”

সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ আসতে শুরু করে। রাত ৮টার দিকে রাজধানীর বনানী, বাড্ডা, খিলক্ষেত, রামপুরা, মিরপুর, গাবতলীসহ কয়েকটি স্থানেও বিদ্যুতের দেখা মেলে।

চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউরী, আসকার দীঘির পাড়, ঘাট ফরহাদবেগ, আন্দরকিল্লা, জামাল খান এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিদ্যুৎ এলেও সন্ধ্যা ৭টার দিকে আবার চলে যায়।

চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা তখন বলেন, যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে তা ‘রেশনিংয়ের’ মতো করে বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিকাল ৫টার পর থেকে কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে চারটিতেই উৎপাদন শুরু হয়েছে।

এছাড়া সন্ধ্যার পর থেকে হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হয়। এছাড়া একই সময়ে দোহাজারী পাওয়ার প্ল্যান্টও চালুর পথে ছিল বলে জানান তিনি।

এর মধ্যেই চালু হয় দেশের নানা প্রান্তের অন্য কেন্দ্রগুলোও।

রাত সাড়ে ১০টায় তোলা ঢাকার এই ছবি বলে দেয় অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরেছে

প্রতিমন্ত্রী রাত পৌনে ১০টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় গ্রিডে ১৫০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে এখন। আশা করছি, মধ্যরাতের মধ্যে রিকভারি হয়ে যাবে।”

এর ৪৫ মিনিট পর পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম-আল-বেরুনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে।

“৮০ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুৎ পাচ্ছেন এখন। মধ্যরাতের মধ্যে বাকিটুকুও রিকভার করে ফেলা যাবে।”

এর মধ্যেই পাল্টে যায় রাতের চিত্র। সন্ধ্যায় ওপর থেকে যে ঢাকাকে দেখা দিয়েছিল অন্ধকারের চাদরে মোড়া, রাত ১১টার পর থেকে সেখানে তারার মতো বাতি জ্বলতে দেখা যায়।

সমস্যা কোথায়?

কী কারণে এই সমস্যা দেখা গিয়েছিল, তার একটি নির্দেশনা কুষ্টিয়ার কর্মকর্তাদের কাছে পাওয়া গেলেও সেটাই মূল কারণ কি না, তা স্পষ্ট করেননি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।  

ভেড়ামারায় আন্তঃদেশীয় গ্রিডের ওখান থেকেই সমস্যা হয়েছে কি- জানতে চাওয়া হলে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার হোসেন তা অস্বীকার করেন।

তিনি সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “না না না। টেকনিক্যাল ফল্টটা খতিয়ে দেখতে আমরা একটা কমিটি করেছি। কমিটি খতিয়ে দেখার আগে কথা বলা ঠিক না।”

বিকালে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম-আল-বেরুনির কাছে কারণ জানতে চাওয়া হলে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে তিনিও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিপর্যয়ের কারণ জানতে চাওয়া হলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “দুটো জিনিস। টেকনিক্যাল ফল্ট তো আছেই। এই টেকনিক্যাল ফল্টটাকে রিকভারি করতে হবে আমাদের। আমাদের সাথে সিস্টেম কাজ করত পারে নাই।

ভেড়ামারা বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র

“আরেকটা বিষয় হিউম্যান এরর (মানবসৃষ্ট ভুল) থাকতে পারে হয়ত। প্রপার টাইমে প্রপার হিট করা, সেটায় গাফিলতি হতে পারে।”

নাশকতার কোনও বিষয় ছিল কি না,এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন- জানতে চাওয়া হলে নসরুল হামিদ বলেন, “না এখনও এ পর্যন্ত আসি নাই। দেখা যাক। কোনও কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভ্রাট এর কারণ নিরূপণ, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এর নেতৃত্বে ৭ (সাত) সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এই কমিটিকে তাদের প্রতিবেদন বিদ্যুৎ সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে দিতে বলা হয়েছে।