মীর কাসেমের রায়ের অপেক্ষা

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় হচ্ছে রোববার।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2014, 05:31 AM
Updated : 5 Nov 2014, 09:17 AM

জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দলটির অন্যতম প্রধান অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাসেমের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রায়ের এই দিন ঠিক করে দেয়। এটি হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত এ ট্রাইব্যুনালের একাদশ রায়।

গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি ঘটনায় অভিযুক্ত করে মীর কাসেম আলীর বিচার শুরু করে আদালত। সাক্ষ্য, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে চলতি বছর ৪ মে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

যুক্তিতর্কে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানরা খান খান করে দিয়েছিল এ দেশকে। সেখানে জন্ম নেয় আরেক বাঙালি খানের নির্মম ইতিহাস।

“১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলীর নির্যাতনের প্রমাণ উঠে এসেছে। সেই ‘বাঙালি খান’ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাই।”

অন্যদিকে প্রসিকিউশন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে আইনি যুক্তিতর্কে আসামি পক্ষের আইনজীবী তানভির আহমেদ আল আমীন আসামির খালাস চান।

অভিযোগ

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ওই সময় চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম শহর শাখারও সভাপতি ছিলেন।

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদেরও দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়।

সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী স্বাধীনতাবিরোধী মূল ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ ছাড়া বাকি সব অভিযোগেই অপহরণ করে নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে।

১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তর সালের ২৮ নভেম্বর ছয়জনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় মীর কাসেমের নির্দেশে।

১২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের নির্দেশে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ তিনজনকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। এরপর সেখান থেকে দুইজনকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়।

বাকি অভিযোগগুলোতে ওমর-উল ইসলাম চৌধুরী, লুৎফর রহমান ফারুক, জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সাইফুদ্দিন খান, আব্দুল জব্বার মেম্বার, হারুন অর-রশিদ খান, মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, নুরুল কুদ্দুস, সৈয়দ মো. এমরান, জাকারিয়া, সুনীল কান্তি বর্ধন ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

মামলা বৃত্তান্ত

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মীর কাসেমকে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। 

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গতবছর ১৬ মে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এরপর ২৬ মে তা আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ রাখে বিচারক।

গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর মীর কাসেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-১। এরপর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানেই ১৮ নভেম্বর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্য দিয়ে শুরু হয় শুনানি।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে এবছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন।

এরা হলেন- সৈয়দ মো. এমরান, মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, সুনীল কান্তি বর্ধন দুলাল, শহীদপুত্র শিবু দাস, মৃদুল কুমার দে, প্রদীপ তালুকদার, মুক্তিযোদ্ধা এস্কান্দার আলম চৌধুরী, মো. সালাহউদ্দিন ছুট্টু মিয়া, মো. জাকারিয়া, নাজিমুদ্দিন, মো. হাসান (১), মো. হাসান (২), ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী, জুলেখা খান, মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী, হাসিনা খাতুন, এসএম জামাল উদ্দিন, এস এম সরওয়ার ঊদ্দিন এবং লুৎফর রহমান ফারুক। জব্দ তালিকার সাক্ষী হলেন চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরির বুক সর্টার কাউসার শেখ, বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া এবং বাংলা একাডেমীর প্রধান গ্রন্থাগারিক মোবারক মিয়া।

সাক্ষ্য শেষে এদের সবাইকে জেরা করে আসামিপক্ষ।

এরপর ২১ ও ২২ এপ্রিল মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাক্ষ্য দেন তিনজন সাফাই সাক্ষী। তারা হলেন- মীর কাসেম আলীর ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিন, চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানাধীন স্টেশন রোডের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী এবং চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খান।

সাক্ষ্য দেয়ার পরে তাদের জেরা করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।

সাক্ষ্য শেষে গত ২৭ ও ২৮ এপ্রিল এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন।

এরপর ২৯, ৩০ এপ্রিল ও ৪ মে কাসেম আলীর পক্ষে যুক্তি দেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন।

সমাপনী যুক্তি উপস্থাপন শেষে চলতি বছর মে মাসে মামলাটি রায়ের জন্য সিএভি করা হয়।

কাসেম আলী

প্রসিকিউশন বলছে, মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের মীর কাসেমকে একাত্তরে চট্টগ্রামের মানুষ চিনতো মিন্টু নামে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে আলবদর সদস্য ও রাজাকাররা চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেল, আসাদগঞ্জের চামড়ার গুদাম ও পাঁচলাইশের সালমা মঞ্জিলে নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে তোলে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নির্দেশনায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়।

১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাসেম তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।

মীর কাসেম আলী জামায়াতের অন্যতম প্রধান অর্থ জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত। তিনি রাবেতা আলম আল-ইসলামী নামে একটি এনজিও’র সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি। এই প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন তিনি জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হিসেবে যোগ দেন।

১৯৮০ সালের পরে  জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য হন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে দলটির শূরা সদস্য হিসেবে নিয়োজিত হন।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক মীর কাসেম জামায়াতসমর্থক বলে পরিচিত দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনেরও চেয়ারম্যান। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন।