‘সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলুন’

সবাইকে সত্য বলতে সাহসী হওয়ার আহ্বান জানালেন সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করাসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার রায় দেওয়া বিচারক এ বি এম খায়রুল হক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2014, 06:45 PM
Updated : 25 Oct 2014, 07:30 PM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে সব পর্যায়ে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার গুরুত্বও তুলে ধরেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি, যিনি বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

খায়রুল হক বলেন, “সবারই দায়িত্ব আছে। সাদাকে সাদা বলুন, কালোকে কালো বলুন, বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকলে চলবে না, বলার শক্তি সঞ্চয় করুন। তাহলে দেশের অবকাঠামোর পরিবর্তন আসবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকবে না, পূরণ করতে আমরা সক্ষম হব।”

নিজেদের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সত্তরোর্ধ্ব এই ব্যক্তি বলেন, “সবার কাছে আমার অনুরোধ- আমরা যেখানেই আছি- আমরা যেন আমাদের উত্তরসূরি সৃষ্টি করে যাই। তাহলেই আমাদের বাংলাদেশ সোনার বাংলা হবে।”

বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চার ওপর জোর দিয়ে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্নের গণতন্ত্রের কথা বলা আছে। সেখানে শুধু নির্বাচনের কথা লিপিবদ্ধ নেই, আছে আইনের শাসনের কথা।

“সবাইকে সবার জায়গা থেকে কৈফিয়ত দিতে হবে। যিনি মন্ত্রী হবেন, তাকে জবাবদিহি করতে হবে সংসদের কাছে। সংসদের মাধ্যমে তা রাষ্ট্রের মালিক জনগণের কাছে পৌঁছাবে।”

খায়রুল হক বলেন, “গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আছে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব বিষয়কে তাদের প্রত্যাশিত না হলে দেশ গণতন্ত্রবহির্ভূত হয়ে থাকতে হবে।”

দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্র ‘নির্মাণ’ করতে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, গণতন্ত্র বিনা দেশে কোনও সাফল্য আসবে না।

“এই যে ধারাবাহিক ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই ফল। গণতন্ত্রের ফসল। সামরিক সরকারের সময় দেশে এই হারে প্রবৃদ্ধি হয়নি।”

সিনেট ভবন মিলনায়তনে ‘গণমানুষের অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক।

‘বারকাতের নোবেল পাওয়া উচিত’

প্রায় কুড়ি জন বক্তার ভূয়সী প্রশংসার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘গণমানুষের অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান; যাতে আবুল বারকাতের ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিৎ’ বলেও মন্তব্য এসেছে।

৯৭৭ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রায় ২০ জন বক্তব্য রাখেন। এর মধ্যে বিচারপতি থেকে শুরু করে অধ্যাপক, নাট্যব্যক্তিত্ব, বীরপ্রতীক, ইসলামী নেতাও ছিলেন।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “আবুল বারকাতের সঙ্গে আমার আজ দ্বিতীয় বার দেখা হল। এর আগে একবার দেখা হয়েছিল; তখন ঘণ্টাখানেক আলাপ হয়েছিল। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম তিনি কত বড় মাপের অর্থনীতিবিদ। আমি নিজেও জানতাম না আমাদের মাঝে এত বড় প্রতিভাবান আছেন। আমি অভিভূত!”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষককে ‘বিশ্ব মানের অর্থনীতিবিদ’ অভিহিত তিনি বলেন, “আমরা সম্মান দিতে কার্পণ্য করি। আমরা সহসা জীবিত অবস্থায় কাউকে সম্মান দিই না। আবুল বারকাতের এই বইটি প্রকাশ করে তাকে সম্মান দিয়ে আশরাফ উদ্দিন একটি বিপ্লব ঘটিয়েছেন।”

সদ্য প্রয়াত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হকসহ ১৫১ জনের লেখা স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থটিতে। 

আবুল বারকাতের অবদানের বিষয়ে খায়রুল হক বলেন, “তার অর্থনীতির মধ্যে শুধু অর্থনীতি সীমাবদ্ধ নেই। রাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি সবই রয়েছে। আইনের স্বাধীনতার কথা, অধিকারের কথা বলা আছে। তিনি মৌলবাদী অর্থনীতির যে বড় কাজ করেছেন, সেটা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এটা আমাদের প্রত্যাশা।”

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বলেন, “বারকাত নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তার কমর্কাণ্ড, গবেষণা, পথচলা সবই মুক্তিযুদ্ধ এবং সংবিধানকে ঘিরে। বাংলাদেশের আর একজন অর্থনীতিবিদকে এমন পাওয়া যাবে না। তার নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত শোলাকিয়ার ইমাম মওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ বলেন, “আজ এমন একটা দিন, যে দিনে বাংলাদেশের জাতশত্রুর কবরে স্থান হয়েছে। আর এই দিনেই আবুল বারকাতের মতো অর্থনীতিবিদের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হয় জাতশত্রুদের দিন শেষ।”

“তার লেখাগুলো মেদহীন, সোজা-সাপটা। খুব সহজেই মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যান তিনি। সহজ কথা সুন্দর করে সহজে বলেন। এমন মানুষের অবশ্যই নোবেল পাওয়া উচিৎ। নোবেল প্রাইজ আমার কাছে থাকলে আমি তাকে অবশ্যই সেটি দিতাম,” বলেন ফরীদউদ্দীন।

সবার আলোচনার পর বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে এই প্রসঙ্গে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “আবুল বারকাত নোবেল প্রাইজ পেলেন কি না, সেটা বড় কথা নয়। তিনি সেটা পাওয়ার যোগ্য কি না, সেটাই বড় কথা। আমাদের মনে রাখতে হবে, মহাত্মা গান্ধীও নোবেল পাননি।”

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আবুল বারকাত একজন ‘মানবতাবাদী অর্থনীতিবিদ’। আর এজন্যই তিনি ‘গণমানুষের অর্থনীতিবিদ’ হয়ে উঠেছেন।

“জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে বিদেশে পিএইচডি করার সুযোগ করে দিতে সিএসআরের মাধ্যমে সহায়তা করেছেন। আমি নিজে অনেক ছাত্রকে তার কাছে পাঠিয়েছি, তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”

বীরপ্রতীক খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি বলেন, “বারকাত আমারে তালাশ করে ১৫ লাখ ঠাকা দিছে। হ্যায় ভালো লুক। চুর-বদমাশ নয়। হে আমার ছেলে..।

“শেখ হাসিনা আমারে এক ইকর খাস জমি দিছে। আর বারকাত দিছে ট্যাকা। এখন আমি ভালো আছি,” ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলেন সুনামগঞ্জে রণাঙ্গণে যুদ্ধে অংশ নেওয়া এই নারী।

শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বক্তব্যে কাঁকন বিবিকে খুঁজে বের করার জন্য বারকাতের প্রশংসা করেন।

‘আবুল বারকাতকে দার্শনিক’ অভিহিত করে একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলেন, “তিনি মুক্তির দর্শন নিয়ে কাজ করেছেন। আমাদের সংবিধানে মুক্তির কথা কিভাবে আছে, তা তিনি সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন।

“আমি বুয়েটের ছাত্র, অর্থনীতি বুঝি না। কিন্তু আমি আবুল বারকাতের গুণমুগ্ধ ছাত্র। সে কারণেই তিনি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ।”

কারও নাম উল্লেখ না করে মোজাম্মেল বাবু বলেন, “মাইক্রোক্রেডিটের নামে বালিশের তলার টাকা নিয়ে; গরিব মানুষের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে অনেকে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। বারকাত তেমনটি নন, সত্যিকার অর্থেই তিনি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ।”

অনুষ্ঠানে আবুল বারকাত উপস্থিত থাকলেও কোনও বক্তব্য রাখেননি। মঞ্চেও ওঠেননি তিনি, দর্শক সারিতে স্ত্রীকে নিয়ে বসেছিলেন তিনি।

অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসানুজ্জামান চৌধুরী, নাট্যব্যাক্তিত্ব মামুনুর রশিদ, বেসরকারি সংস্থা প্রিপ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক অ্যারোমা দত্ত, ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিক-উজ জামান, সোনার বাংলার প্রকাশক ফুলু সরকার, আদমজী পাটকল শ্রমিক লীগের সভাপতি শামসুদ্দিন মিয়া, বিআইডিএসের গবেষক আবুল বারকাতের ছাত্রী হোমায়রা আহমেদ, হারুনুর রশীদও বক্তব্য রাখেন।