যুদ্ধাপরাধীদের ‘গুরু’ গোলাম আযমের মৃত্যু

বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যার নাম আসে সবার আগে, সেই গোলাম আযম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সাজা ভোগের মধ্যেই মারা গেছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2014, 04:36 PM
Updated : 25 Oct 2014, 12:23 PM

৯২ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে তার, যার আরও ৮৯ বছর কারাভোগ বাকি ছিল।

বিচারাধীন অবস্থা থেকে এই হাসপাতালে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযম। গত বছরের ১৫ জুলাই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ের পরও এখানেই ছিলেন তিনি।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষের আপিলের শুনানির দিন ঠিক হওয়ার একদিন বাদেই গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটার খবর আসে।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে, তারও কয়েক ঘণ্টা পর মধ্যরাতে সাংবাদিকদের সামনে এসে মৃত্যুর ঘোষণা দেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া।

যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে গোলাম আযমের আগে শাস্তি ভোগের সময় মৃত্যু হয় আব্দুল আলীমের। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার মামলারও কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায়।

গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের রায় দেওয়ার সময় বিচারক বলেছিলেন, আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হল।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের তখনকার আমিরকে।

তার তার জন্য যে শাস্তি তাকে দেওয়া হয়, তা এক বছর তিন মাস খেটেই মারা গেলেন তিনি। জীবদ্দশায় যিনি একাত্তরের বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কখনও ক্ষমা কিংবা দুঃখ প্রকাশও করেননি। 

গোলাম আযমের অবস্থার অবনতির খবর শোনার পর হাসপাতালের পরিচালক মজিদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “বিকালে তার প্রেসার কমে যায়। এ কারণে ওষুধ দিয়ে প্রেসার স্বাভাবিক রাখা হয়। এক কথায় ওষুধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।”

তখন থেকে গোলাম আযমের কথা বলায় জড়তা দেখা দেয় বলে মজিদ ভূঁইয়া জানান।

রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলে শীর্ষ এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রাত পৌনে ১২টার দিকে জামায়াত নেতার মৃত্যুর ঘোষণা আসে।

হাসপাতালের পরিচালক মজিদ ভূঁইয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে গোলাম আযমের মৃত্যু হয়। 

বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর জামায়াত নেতাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।”

হাসপাতালে উপস্থিত গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী রাত সোয়া ১১টার দিকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “মনে হল, আমার বাবা আর নাই। নিস্তেজ অবস্থায় আছেন। তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে ডাক্তাররা এখনও আমাকে কিছু জানায়নি।”

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হেফাজতে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন জামায়াত নেতা। সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে ঢাকার জেলার মো. নেছার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

রাতেই হাসপাতালে ম্যাজিস্ট্রেট তারিক হাসানের উপস্থিতিতে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করে দেয় পুলিশ, যা শেষ হয় রাত ৩টায়। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে রাখা হয়েছে।

তবে ময়নাতদন্তের না করে লাশ হস্তান্তরের জন্য গোলাম আযমের পরিবার ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন দিয়ে চেয়েছেন। তাদের সকালে যেতে বলেছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

গোলাম আযমকে মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আজমী। তবে তা তার অন্য ছেলেরা দেশে ফিরলে কয়েকদিন পর হবে বলে জানান। সেই পর্যন্ত এই যুদ্ধাপরাধীর লাশ থাকবে হিমঘরে।

১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া গোলাম আযমের পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাঁওয়ে।

ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (এখনকার কবি নজরুল কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।

গত শতকের ’৪০ এর দশকে এক মেয়াদে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন গোলাম আযম। ওই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জিএস হিসেবে তার একটি স্মারকলিপি দেওয়াকে ‘ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা’ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালায় তার দল জামায়াতে ইসলামী; যদিও পরে তিনি নিজেই তার ওই পদক্ষেপ ভুল ছিল বলে উল্লেখ করেন।

ছাত্রজীবন শেষে ১৯৫০ থেকে পাঁচবছর রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান গোলাম আযম। ওই সময়ই সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর ইসলামী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন তিনি।

ফাইল ছবি

ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মওদুদীকে, আর তার শিষ্য গোলাম আযমও একই অপরাধ করেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। 

১৯৬৯ সালে গোলাম আযম যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন তখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; তা-ও পাকিস্তানি পাসপোর্টে

বাংলাদেশে ফেরার পর ১৯৮১ সালে বায়তুল মোকাররমে একটি জানাজা পড়তে গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের এই নেতা। 

১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার পর ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর জামায়াত গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন।

ওই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আবার সামনে আসে, যার পরিণতিতে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়।

এর মধ্যে আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আযম। এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছিলেন, থাকছিলেন মগবাজারে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। পরের বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তিনি বিএসএমএমইউতে ছিলেন এবং বৃহস্পতিবার মারাও গেলেন সেখানে।