এ আক্ষেপ ঘোচার নয়: সাইদা খানম

তার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হয়েছেন রানি এলিজাবেথ, মাদার তোরেসা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নিল আর্মস্ট্রংয়ের মতো ব্যক্তিত্বরা; তবু বাঙালির বিজয় মুহূর্তের ছবি তুলতে না পারার আক্ষেপ কখনোই তার ঘুচবে না।

শামীমা বিনতে রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2014, 02:01 PM
Updated : 22 Oct 2014, 07:29 PM

জীবনের ৭৭তম বছরে দাঁড়িয়ে নিজের বর্ণময় অতীতের দিকে ফিরে দেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানমের কণ্ঠে সে আক্ষেপই ঝরল।

“সবচে দুঃখ কী জানো, একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করল যেদিন, সেই দিনের ছবি তুলতে গিয়ে গুলির তোপে পড়ে ছবি তুলতে পারিনি।”

সাইদা খানমের হাত ধরেই বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোকচিত্র বিষয়ক নতুন ওয়েবসাইট click.bdnews24.com এর। তার সঙ্গে থাকবেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন।

আট বছর পূর্তি উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বাছাই করা ছবি নিয়ে পাঁচ দিনের এক প্রদর্শনীর শুরু হচ্ছে গুলশানের র‌্যাডিয়াস আর্ট গ্যালারিতে (বে’স গ্যালারিয়া), যার শিরোনাম ‘ক্যাপচারিং বাংলাদেশ’।

এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার কথা ছিল সাইদার বোনের স্বামী, সদ্য প্রয়াত ইতিহাসবিদ এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদের। কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যুর পর নিভৃতচারী সাইদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে থাকতে সম্মত হন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় সাইদা খানম এক ঝলকে ফিরিয়ে আনলেন ফ্রেমবন্দি টুকরো অতীত।

১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় জন্ম নেওয়া সাইদা খানমের সঙ্গে ক্যামেরার সখ্য সেই ১২ বছর বয়সে। আর ফটো সাংবাদিকতার শুরু ৬০ এর দশকের শুরুতে, তখনকার বেগম পত্রিকায় কাজের মধ্য দিয়ে।

পেশাদার আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার পথে সাইদা উৎসাহ পেয়েছেন বড় বোন হামিদা খানমের কাছ থেকে, যিনি অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদের স্ত্রী।

হামিদা খানম ছিলেন ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বোনের জন্য তিনি নিয়ে আসেন রোলিকর্ড ক্যামেরা, যা তখনকার পেশাদাররা ব্যবহার করতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে দুটো মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার পথেই সাইদা খানম তার ক্যামেরায় ধারণ করতে থাকেন সময় আর মানুষের মুখ, ইতিহাস আর জীবনের আখ্যান।

বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রহাতে প্রশিক্ষণের যে ছবি সাইদা খানম তুলেছেন, তা এখন বাংলাদেশের ইতিহাসেরই অংশ।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি তুলতে তখনকার রেসকোর্স ময়দানের দিকে রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে তা আর হয়ে ওঠেনি।  

“আমরা তিনজন মেয়ে, আমার হাতে ক্যামেরা। আজিমপুরের বাসা থেকে বের হয়ে রেসকোর্সে যাওয়ার পথে গুলির মুখে পড়লাম। পাকিস্তানি আর্মির টানা গুলি। গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম প্রথমে। খুব গুলি চলছিল। তারপর শুয়ে পড়লাম মাটিতে। গুলি বন্ধ হলে তিনটি বাড়ির বড় বড় দেয়াল টপকে বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম। সেই ছবি না পাওয়ার দুঃখ আমার যাবে না।”

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবি তোলার কথা স্মরণ করে আজও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সাইদা খানমের মুখ। চিত্রালীর সম্পাদক এস এম পারভেজের কথায় কান না দিয়ে ঠিকই তিনি হাজির হয়েছিলেন কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির দরজায়।

“এমন ভরাট গলা জীবনেও শুনিনি। আমার আগেই বিশ্বাস ছিল, পথের পাঁচালী যে পরিচালক বানাতে পারেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে সাক্ষাৎকার নিতে আসা একজনের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারবেন না।”

বাংলাদেশ থেকে সাইদাই প্রথম সত্যজিতের সাক্ষাৎকার নিয়ে আসেন, যেটি চিত্রালীতে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।

বাংলাদেশের ছবি নিয়ে সাইদা খানম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, পেয়েছেন বহু পুরস্কার। তার তোলা সত্যজিৎ রায় আর মাদার তেরেসার ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনীও হয়েছে।

ফটো সাংবাদিক হিসাবে দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সাইদা খানমের তোলা প্রায় ৩ হাজার ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ক্যামেরার পাশাপাশি কাজ করেছেন কলম হাতেও। তার লেখা ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়।

বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সদস্যা সাইদা খানম বাংলা একাডেমিরও আজীবন সদস্য।