ওদের ঘরে কান্না আর হাহাকার

নাটোরের বড়াইগ্রামে সোমবারের দুর্ঘটনায় স্বজনহারাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবরা নিজেরাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন। তারপরও চোখের জলে পাশে দাঁড়াচ্ছেন তাদের।

নাটোর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2014, 12:10 PM
Updated : 22 Oct 2014, 04:32 PM

এ দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন একজন, কেউবা দুজন, আবার কারো পরিবারের নিহত হয়েছেন ছয়জন।

গত সোমবার নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান ৩৪ জন। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধি বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর গিয়ে দেখে আসেন নিহতদের স্বজনদের আর এলাকার মানুষের কান্না ও কষ্টের চিত্র। 

মঙ্গলবার সকাল তখন সোয়া ৯টা। বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের মানিকপুর মোড় থেকে চার কিলোমিটার মাটির সড়ক ধরে হেঁটে তারানগর গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে হাজারও মানুষ নীরবে লাশের কফিন নিয়ে যাচ্ছে জানাযার মাঠের দিকে।

একটি কফিনে রয়েছে বাবা ও মেয়ের লাশ।

কফিনের মিছিলের এক যুবক জানান, সোমবারের দুর্ঘটনায় তারানগর গ্রামের সামাদ মোল্লার ছেলে জামাল উদ্দিন (৩৮) ও তার মেয়ে জান্নাতি খাতুনের (৪) মৃত্যু হয়েছে।

মিছিল পেরিয়ে জামাল উদ্দিনের বাড়ি গিয়ে কথা হয় তার স্ত্রী জাকিয়া খাতুনের সঙ্গে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার বিকালে বাবার বাড়ি সিংড়ার হিজলী থেকে স্বামী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে গুরুদাসপুরের অথৈ পরিবহনের একটি বাসে বাড়ি ফিরছিলেন।

পথে রেজির মোড়ে বিপরীতমুখী কেয়া পরিবহনের একটি বাস তাদের বাসকে ধাক্কা দিলে ঘটে যায় সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। মুহূর্তে তাদের গাড়িটি দুমড়েমুছড়ে যায়। আরও অনেকের সঙ্গে তার স্বামী ও মেয়ের মৃত্যু হয়। তিনি নিজে গুরুতর আহত হয়ে বনপাড়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন।

কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি এসেছেন শেষবারের মতো স্বামী ও মেয়েকে দেখতে কবরে নেয়ার আগে।

কথা বলতে বলতে তিনি বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। এরপরও থেমে থেমে বলছিলেন স্বামীর কিছু অপ্রাপ্তির কথা।

তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে তার স্বামী জামাল উদ্দিন ২০০১ সালে স্থানীয় জোনাইল ডিগ্রি কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো গত ১৪ বছরেও তিনি কোনো বেতন পাননি।

জাকিয়া খাতুন বলেন, বিনা বেতনে পড়িয়েও তার স্বামীর মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না। তিনি বলতেন, ছেলেমেয়েদের পড়িয়েই তিনি আনন্দ পান। সংসারে তেমন একটা অভাব অনটন ছিল না। তাই সঠিক সময়ে বিয়ে করেছেন, সন্তান নিয়েছেন। ভালেই কাটছিল তাদের ছোট্ট সংসার।

চালকের খামখেয়ালিপনায় মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল।

সন্তান হারিয়ে জামাল উদ্দিনের বাবা সামাদ মোল্লাও শরীর ও মনের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। দুই যুবক তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে জানাযায় অংশ নিতে।

তিনি জানান, তিন সন্তানের মধ্যে জামালকে তিনি উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। এ ছেলেকে নিয়ে তিনি গ্রামে মাথা উঁচু করে চলেন। কিন্তু দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।

এভাবেই বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে লাশের মিছিলের সঙ্গী ছিল কান্না আর হাহাকার।

তারানগর গ্রামের পর সকাল সাড়ে ১০টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধি পৌঁছেন বড়াইগ্রামের ইকোড়ী গ্রামে।

এখানে স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে মনিরুল ইসলাম (২৮) ও ভাগ্নি সাহিনা খাতুনের (৮) লাশ নিয়ে লোকজন জানাযার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারাও ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন।

মনিরুলের মা ছাবিনা ইয়াসমিনও ওই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি বগুড়া সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা নিয়েছেন।

এদিকে গুরুদাসপুরের সিধুলি গ্রামের নিহত ১২ জনের জানাজা মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় এবং অপর দুজনের জানাজা যোহরের নামাজের পর সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।

স্থানীয় কবরাস্থানে একইসঙ্গে ১২টি এবং অন্যপাশে দুটি কবরে পরে তাদের দাফন করা হয়।

জানাজার জন্য বাড়ি থেকে লাশগুলো স্কুল মাঠে নেয়ার সময় পুরো এলাকায় কান্নার রোল পড়ে যায়। এই দৃশ্য দেখে জানাজায় আগত দুই উপজেলার হাজারো মানুষ তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।