যুগ যুগ ধরে এ পল্লীর মানুষগুলো সুইপারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছে তারা। যা উপার্জন করে, তা দিয়ে চলে খাওয়া-পড়া আর হইহুল্লোড়।
জীবনের আলোর দিক নিয়ে কারো কোনো ধারণা কিংবা মাথা ব্যথা আছে কি না জানে না কেউ।
এ পল্লীর এক পরিবারের দুই শিশু এর বাইরে বের হতে চায়। তারা চায় লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে।
তাদের স্বপ্ন তারা একদিন এ হরিজন পল্লী ছেড়ে চলে যাবে। গড়ে নেবে একটি সুন্দর সুস্থ জীবন।
হরিজন পল্লীর সুজন ও শিউলি বাসফোড়ের মেয়ে ছেলে দীপালী রানি বাসফোড় (১৩) ও ছেলে সুমিত বাসফোড় (১১)।
দীপালী পড়ে সপ্তম শ্রেনিতে এবং সুমিত পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। দুজনই ক্লাসে প্রথম হয় বরাবর।
সুমিতের স্বপ্ন, সে একদিন বড় পুলিশ অফিসার হবে, আর দীপালীর স্বপ্ন, সে ডাক্তার হবে।
এজন্য দুই ভাই-বোন নিয়মিত লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে হরিজন পল্লীর শত প্রতিকূলতার মধ্যেও।
রাতে পল্লীর সবাই যখন মাদক সেবন নিয়ে মেতে থাকে, তখন এ দুই ভাই-বোন থাকে পড়ার টেবিলে। তারা গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে।
সুমিতের বাবা সুজন বাসফোড় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বাবা ভবানী বাসফোড় ছিলেন ওই হরিজন পল্লীর মুখিয়া অর্থাৎ বিচারক। তিনি নিজে সুখানপুকুর রেলওয়ে স্টেশনে সুইপারের কাজ করেন। সুজনের স্ত্রী শিউলি রানী বাসফোড় গৃহিনী।
তাদের সুইপারের কাজ করতে তার আর ইচ্ছা করে না। কিন্তু তাদের বাধা এ সমাজ। তাই তারা একদিন এ হরিজন পল্লী ছেড়ে যেতে চান, যেখানে তাদের কেউ হরিজন বলে চিনবে না, বলেন সুজন।
শিউলী রানী বাসফোড় জানান, মদ খাওয়া, মাদক বিক্রি করা প্রভৃতি তাদের পূর্ব পুরুষদের সময় থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু এটা আর ভাল লাগে না। এখান থেকে নিষ্কৃতি চান তিনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের ইচ্ছা ছেলে-মেয়েরা ভালো কলেজে ভর্তি হলে তারা গোপনে ছাড়বেন হরিজন পল্লী।
সুমিত ও দিপালীর মামা রাজন জামালপুর জেলার গোহাটী হরিজন পল্লীর ছেলে। তিনি ভগ্নিপতি সুজনের বাড়িতে থাকেন। নিজে পড়েন বগুড়ার শাহ সুলতান কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে। রাজনই পড়লেখার ব্যাপারে তার ভাগিনা এবং ভাগনিকে উৎসাহ দেন। তিনি নিজে তাদের পড়ালেখা করান।
রাজন বলেন, তিনি চান এই পল্লীর সবাই অন্ধকার ছেড়ে আলোতে আসুক।
সরেজমিনে হরিজন পল্লীতে দিয়ে দেখা গেছে, দিনের বেলায় ওই হরিজন পল্লী ছোট ছেলে-মেয়েসহ বয়স্করা নেশা করছে এবং তাস খেলছে। একই পল্লীতে যখন তারা তাস খেলায় ব্যস্ত তখন ওই দুই সহদর স্কুলে পড়া লেখা নিয়ে ব্যস্ত। রাতে ওই পল্লীতে সব বয়সী নারী-পুরুষ যখন গাঁজার পুড়িয়া, বাংলা ও চোলাই মদ বিক্রি করে, তখন রাত ১২ টা পর্যন্ত তখন সুমিত ও দীপালী ব্যস্ত থাকে পড়ার টেবিলে।
সুমিতের শিক্ষিকা সুত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রোকেয়া সুলতানা জানান, সুমিত খুব ভাল ছাত্র। পরীক্ষায় সে প্রথম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে।এখানে হরিজন বলে ছাত্র-শিক্ষক কেউ তাদের অবজ্ঞা করে না।
অনেক হরিজনের সন্তান স্কুলে প্রথম পর্যায়ে ভাল ফলাফল করলেও পরে পরিবেশের কারণে তারা ঝরে পড়ছে। স্কুলে এমন নজিরও রয়েছে।
সূত্রাপুরের স্টাডি পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষিকা কামরুন নাহার জানান, দীপালীর মতো মেধাবী ছাত্রীদের আরও একটু দৃষ্টি বাবা-মা নিলে আরও ভাল করবে। দীপালী সপ্তম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। এখানে সহপাঠীরা ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা হরিজন বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে না।