পথে পথে ঘরে ফেরার গান

বড় ‍দুটো ধর্মীয় উৎসবের ছুটি শুরুর আগে শেষ কর্মদিবসেই সড়ক, নৌ ও রেলপথে ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে।   

কামাল তালুকদারআশিক হোসেন, ও কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2014, 02:02 PM
Updated : 2 Oct 2014, 02:02 PM

স্বজনদের সঙ্গে ঈদ-পূজার আনন্দ ভাগ করে নেয়ার এই যাত্রায় বরাবরের মতোই তাদের সঙ্গী হচ্ছে যানজটে ভোগান্তির শঙ্কা। সেই সঙ্গে বাসের জন্য দীর্ঘ সময় প্রতীক্ষা আর বেশি দামে টিকেট বিক্রির অভিযোগও রয়েছে।  

দুর্গা পূজা ও কোরবানির ঈদের ছুটি শনিবার শুরু হলেও মাঝখানে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসেই মানুষ রাজধানী ছাড়তে শুরু করে।

সকালে গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী ও মহাখালীতে বাস কাউন্টারগুলোর সামনে অনেককে বাসের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা যায়। বিকালে ভিড় আরো বাড়ে।

রেলের টিকেট আগেই বিক্রি হয়ে যায় বলে কমলাপুরের কাউন্টারে খুব একটা ভিড় দেখা যায়নি। তবে অনেকেই ‘স্ট্যান্ডিং টিকেট’ কেটে বাড়ি ফেরার চেষ্টায় আছেন।

ট্রেনগুলোও মোটামুটি সময় মেনে যাত্রী নিয়ে রওনা হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদেও ভ্রমণ করতে দেখা গেছে যাত্রীদের।

আর সদরঘাটে ভিড় শুরু হয় দুপুরের পর থেকে। দক্ষিণের ৪০টি নৌপথে শতাধিক লঞ্চ যাত্রী পরিবহনে প্রস্তুত থাকলেও টিকেট শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।

গত রোজার পর মোটামুটি স্বস্তিতে ঈদযাত্রা হলেও সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে টানা বৃষ্টিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন সড়কের অবস্থা অনেকটাই করুণ। ফলে গত তিন দিন ধরেই রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম ও উত্তরের পথে যানবাহন চলছে ধীর গতিতে। 

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, মহাসড়কে এই যানজটের কারণ সড়ক নয়। বিভিন্ন স্থানে কোরবানীর পশুবাহী ফিটনেসবিহীন ট্রাক বিকল হয়েই বিপদ ঘটাচ্ছে।

তবে মাওয়া ও পাটুরিয়ায় এবার যানজট না থাকায় দক্ষিণের পথে যাত্রীদের ভোগান্তি খানিকটা লাঘব হয়েছে।  

টার্মিনালে বাসের অপেক্ষা

বৃহস্পতিবার সকালে গাবতলী বাস কাউন্টারগুলোর সামনে অনেককেই বাসের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা যায়। বিকালে অফিস ছুটির পর এই ভিড় আরো বাড়ে।

কাউন্টারগুলো থেকে জানানো হয়, মহাসড়কে ধীরগতির কারণে বাস আসতে কিছুটা সময় লাগছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এনায়েত উল্ল্যাহ স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঈদ করতে দিনাজপুরে যাচ্ছেন। গাবতলীর মাজার রোড এলাকার নাবিল পরিবহনের কাউন্টারের সামনে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল ৭টায় বাস ছাড়ার কথা ছিল, এখানে আসার পর জানতে পারলাম দেরি হবে। এখন আবার বাসায় গিয়ে ফিরে আসার সময় নেই, তাই অপেক্ষা করছি।”

দুপুরে বালুঘাট এলাকায় উত্তরবঙ্গগামী হানিফ পরিবহনের টার্মিনালেও দেখা গেলো অপেক্ষায় রয়েছেন যাত্রীরা।

হানিফ পরিবহনের কর্মী বাদশাহ বলেন, “ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজটের কারণে গাড়ি ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগছে।”

গাবতলী থেকে ফরিদপুরগামী আনন্দ পরিবহনের কর্মী কাওসার বলেন, “মূলত আজই বেশির ভাগ মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। এ কারণে চাপ পড়েছে।”

ময়মনসিংহ রুটের বাসের টিকেট আগে থেকে দেয়া হয় না বলে মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা গেল দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনছেন যাত্রীরা। ময়মনসিংহ ছাড়াও শেরপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, জামালপুরের গাড়িগুলো এখান থেকেই ছাড়ে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাকে ৪১ নম্বর বাসের টিকেট দেয়া হয়েছে। এখন ৩৫ নম্বর বাস ছাড়ছে। কতক্ষণ লাগবে কে জানে?”

ময়মনসিংহগামী এনা ট্রান্সপোর্টের কর্মী মো. ইকবাল বলেন, “এই কাউন্টার থেকে অগ্রিম টিকেট দেয়া হয় না। যে আগে আসবে সেই আগে টিকেট পাবে।”

পরিস্থিতি দেখতে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালে এসে যাত্রীদের নানা অভিযোগের মুখে পড়েন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

যাত্রীরা বেহাল ময়মনসিংহ সড়কের কথা তুলে ধরলে মন্ত্রী তাদের মার্চ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করেন। ঈদের সময়ে পরিবহন মালিকরা বাড়তি ভাড়া আদায় করেন বলেও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। 

মাওয়ায় বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক সিরাজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধি ফারহানা মির্জাকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ফেরি ঘাটে যানবাহনের চাপ থাকলেও বেলা বাড়ার পর আর সমস্যা হচ্ছে না। যানবাহন আসার পরপরই পার হয়ে যাচ্ছে।

মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে ১৮টি ফেরি দিয়ে পারাপার চলছে। বিআইডব্লিউটিসির সহকারী মহাব্যবস্থাপক এএসএম আশিকুজ্জামান জানান, পদ্মায় নাব্য সঙ্কট থাকলেও ড্রেজিংয়ের কারণে আপাতত সমস্যা হচ্ছে না।

ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরা

রেলের টিকেট আগাম বিক্রি হয় বলে কমলাপুর রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারগুলোতে বৃহস্পতিবার ভিড় নেই খুব একটা। যারা আছেন, তারা এসেছেন বিক্রি না হওয়া টিকেটের খোঁজে, অথবা ‘স্ট্যান্ডিং’ টিকেটের আশায়।

তবে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন অনেকে। অধিকাংশ ট্রেনেই দেখা গেছে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

রাজশাহী যাওয়ার টিকেটের জন্য কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মো. আতাউর রহমান। 

মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আতাউর বলেন, “আজই  বাড়ি যাব। দেখি টিকেট না পাই, তাহলে স্ট্যান্ডিং টিকেটেই যাব।”

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক ম্যানেজার মো. খায়রুল বশীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্রিম টিকেট বিক্রি শেষ। তবে যদি টিকেট থাকে তাহলে ঈদের আগের দিন পর্যন্তও তা বিক্রি হবে।”

তিনি বলেন, এখন অনেকে টিকেট ফেরত দেয়ার চেষ্টা করলেও তা ফেরত নেয়া হচ্ছে না।

“অগ্রিম টিকেট বিক্রির সময় রাত জেগে অনেক মানুষ টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু টিকেট পাননি। তাদের কষ্টটা একবার চিন্তা করেন। যারা তখন পেয়েছেন তারা এখন ফেরত দিলেও নেয়া হবে না।”

টিকেট কালোবাজারির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা একদমই ঠিক নয়।”

স্টেশনে নিরাপত্তা রক্ষায় কর্মরত আনসার সদস্য মোহাম্মদ আলীও বলছেন, অগ্রিম টিকেট বিক্রির সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ‘কালোবাজারীদের উৎপাত’ এখন নেই।

রেলওয়ে থানা পুলিশের তথ্যকেন্দ্র থেকে উপ-পরিদর্শক ইমাম আরেফিন জানান, বুধবার ৬/৭ জনকে কালোবাজারী সন্দেহে আটক করা হয়েছিল। তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার আর কাউকে আটক করা হয়নি।

গত ২৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ঈদের অগ্রিম টিকেট বিক্রি করা হয়। শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে ফিরতি টিকেট বিক্রির পালা।

রেলওয়ের ট্রাফিক পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোনো কেনো ট্রেন আট-দশ মিনিট দেরি করলেও মোটামুটি সময়মতোই সব ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। 

ঈদ উপলক্ষে শুক্রবার থেকে তিনটি বিশেষ ট্রেন বিভিন্ন গন্তেব্যে ছেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।

সদরঘাটে ঠাঁই নাই

দিনের প্রথম ভাগে সদরঘাটে খুব বেশি ভিড় না থাকলেও দুপুরের পর থেকে দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার যাত্রীরা লটবহরসহ আসতে শুরু করেন। যাত্রীবোঝাই করে গন্তব্যের উদ্দেশে ছাড়তে শুরু করে লঞ্চ।

বিআইডব্লিউটিএ জানায়, এবার নৌপথের ৪০টি রুটের জন্য প্রায় দেড়শ লঞ্চ রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫০টি লঞ্চ সদরঘাট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাবে। তবে ঈদের দুই-একদিন আগে গড়ে শাতাধিক লঞ্চ ঢাকা ছাড়েবে।

তবে যাত্রীদের অভিযোগ, টিকেট শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে লঞ্চ মালিকরা।  

বরিশালগামী যাত্রী রহিম মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেবিনের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না এবং টিকেটের দামও বেশি নিচ্ছে।”

অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বরিশালগামী লঞ্চ টিপু’র ব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন।

তিনি বলেন, বরিশালের ডেকের ভাড়া ২৫০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ‘এসি’ ১১শ’ এবং ‘নন-এসি’ ১ হাজার; ডাবল কেবিন ‘এসি’ ২২ শ’ ও ‘নন এসি’ দুই হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে।

“সরকার নির্ধারিত ভাড়া আরো বেশি। কিন্তু প্রতিযোগিতা থাকায় আমরা সাধারণত সরকারি নির্ধারিত ভাড়ার কম নেই। ঈদের সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়া নেয়ার চেষ্টা করি। তাই যাত্রীরা মনে করেন আমরা ভাড়া বেশি নিচ্ছি।”

এদিকে নৌপথে দুর্ঘটনা এড়াতে সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক জয়নাল আবেদীন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যাত্রীদের নিরাপত্তা ও হয়রানি ঠেকাতে প্রতিটি ঘাটে পুলিশ, নৌ-পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কোনো লঞ্চ যাতে ছেড়ে না যায় সেদিকে কঠোর নজরদারি রয়েছে।”

সদরঘাটে ২১ জন ম্যাজিস্টেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত এ বিষয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

কেরানীগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মাকসুদা লিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সদরঘাটে যাত্রী নিরাপত্তায় নদীতে চারটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার, তিনটি স্পিড বোট ছাড়াও রয়েছে একটি ‘ওয়াচ টাওয়ার’।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার (বিআইডাব্লিউটিসি) সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ জানান, ছুটিতে যাত্রী পরিবহনের জন্য ১ থেকে ১২ অক্টোবর নৌপথে বিশেষ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বুধবারও দুটি সরকারি জাহাজ (স্টিমার) সদরঘাট থেকে ছেড়ে গেছে।