‘আব্দুল জব্বারে নির্দেশে ভাইকে খুন’

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রসিকিউশনের অষ্টম সাক্ষী মোজাম্মেল হক শরীফ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2014, 04:52 PM
Updated : 23 Sept 2014, 04:52 PM

সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ মে ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের নির্দেশে রাজাকার ও মুসলিম লীগ নেতারা তার বড় ভাই মোতালেব শরীফকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন ৬৩ বছর বয়সী মোজাম্মেল হক। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ফুলঝুরি গ্রামের এ বাসিন্দা পেশায় কৃষিজীবী।

সাক্ষী বলেন, তার ভাই সেনাবাহিনীতের কাজ করতেন এবং ১৯৭১ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার ভাইসহ তাদের গ্রামের রাজ্জাক বিশ্বাস ও দুলাল নামের আরেকজন কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে গ্রামে চলে আসে। গ্রামের যুবকদের তারা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।

“মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের খবর আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের কাছে গেলে ১৯৭১ সালের ১৬ মে তুষখালী হাইস্কুল মাঠে একটি মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেন তিনি। ওই মিটিংয়ে আসামি জব্বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস ও আমার ভাই মোতালেব শরীফকে জীবিত অথবা মৃত হাজির করার জন্য রাজাকারদের নির্দেশ দেন।”

“ওই দিন বিকালে স্থানীয় রাজাকার ও মুসলিমলীগ নেতারা আমাদের গ্রামে হামলা দিয়ে আমার ভাই মোতালেব শরীফ ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ী ঘেরাও করে। মোতালেব শরীফ আত্মরক্ষার জন্য দৌড় দিলে রাজাকার বাহিনীর লোকজন তাকে গুলি করে, গুলিবিদ্ধ হয়ে সে ঘটনাস্থলে মারা যান।”

তিনি আরো বলেন, আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস পাশের অন্য একটি বাড়িতে লুকিয়ে থাকাবস্থায় তাকে ধরে এনে গুলি করে রাজাকাররা। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পর মারা যায়।

সাক্ষ্যে তিনি আরো উল্লেখ করেন, পরের দিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ মে সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনীর দুটি গ্রুপ গ্রামের দুই দিক থেকে তাদের গ্রামে আসে।

“তাদের সঙ্গে আসামি আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ও রাজাকার কমান্ডার ইস্কান্দার মৃধাও ছিল। তারা আসার সময় শারদা কান্ত পাইককে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।”

“আব্দুল জব্বারসহ পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা আমাদের বাড়ীঘর লুট করার পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক বিশ্বাসসহ গ্রামের আনমানিক ৩৬০টি বাড়ি-ঘর লুট করে অগ্নিসংযোগ করে। মোতালেব শরীফের লাশটি তার ঘরে ছিল, অগ্নিসংযোগের ফলে ওই লাশটিও পুড়ে যায়।”

তিনি জানান, ওই ঘটনার সময় গ্রামের ধানক্ষেতে লুকিয়ে থেকে পুরো ঘটনা দেখেছিন তিনি। পরে বিকালে তার ভাই ও মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক বিশ্বাসের পুড়ে যাওয়া লাশ দাফন করেন তিনি। 

পলাতক আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে চেনেন বলেও সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন মোজাম্মেল হক। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে আংশিক জেরা করেন জব্বারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।

গত ১৪ অগাস্ট একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ অভিযোগে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ‘পলাতক’ আব্দুল জব্বারের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।
পিরোজপুরের সাবেক সাংসদ আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় গত ১ মে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ছাড়াও ৩৬ জনকে হত্যা, ২০০ জনকে ধর্মান্তরিতকরণ, ৫৫৭টি বাড়িঘরে লুটপাট চালানো ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গত ১২ মে জব্বারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হওয়ায় এরপর নিয়ম অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। তাতেও তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় বিচারক তাকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু করেন।

পলাতক জব্বারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবুল হাসানকে নিয়োগ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। গত ৮ জুলাই তাকে নিয়োগ করে আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

গত ২০ জুলাই আদালতে জব্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা। অপরদিকে বিরোধিতা করে শুনানি করেন তার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়, আব্দুল জব্বারের শ্বশুর ছিলেন স্থানীয় মুসলীম লীগ নেতা। জব্বার নিজে ছিলেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। জাতীয় পার্টির টিকিটে মঠবাড়িয়া থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ৮০ বছর বয়সী এই প্রকৌশলী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা প্রবাসী।

তার বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৯ মে তদন্ত শুরু করে ২৮ এপ্রিল ২০১৪ সালে তদন্ত শেষ করা হয়।পাঁচটি অভিযোগে ৭৯ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে মোট ১ হাজার ৯শ’ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন চুড়ান্ত করা হয়।