‘আমাকে মুক্তি দিতেই ওরা চলে গেল’

মা অন্তপ্রাণ দুই সন্তানের এমন ‘ছুটি’ মেনে নিতে পারছেন না সাংবাদিক জয়শ্রী জামান। কান্না আর সন্তানদের স্মৃতি হাতড়েই এখন কাটে তার এক-একটা মুহূর্ত।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2014, 04:48 AM
Updated : 20 Sept 2014, 04:48 AM

স্বজনদের ধারণা, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, আত্মসম্মানবোধ, নিজেদের চোখে দেখা মায়ের কষ্ট- এসব থেকে মুক্তি পেতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় জয়শ্রীর মেয়ে চিরশ্রী জামান (১৮) ও ছেলে মোহাম্মদ বিন আলীম (১৫)।

মঙ্গলবার উত্তরার ভাড়া বাসা থেকে তাদের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।

জয়শ্রী নিজেও বলছেন, তাকে কষ্ট থেকে ‘মুক্তি’ দিতেই তার নয়নের দুই মনি এ পথ বেছে নেয়।

মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে জীবন সংগ্রামের নানা কথা বলছিলেন জয়শ্রী: “অনেক কষ্ট করেছি তাদের নিয়ে। সারা রাত ধরে কাপড় ধুইতাম। সকালে হালকা লিপস্টিক লাগাতাম, যেন বাচ্চারা বুঝতে না পারে সারা রাত কষ্ট করেছি। একটা রাতও কোথাও কাটাইনি তাদের ছাড়া। এখন আমি কিভাবে কাটাব?”

কথার ফাঁকে চোখ মুছছিলেন। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল তার। তবুও যেন অনেক কথা না বলা রয়ে গেছে, তাই কষ্টকে চাপা দিয়েই বলতে থাকেন।

“বাসায় পানির সমস্যা ছিল, তাই কোক, পানি, বারগার আর পিৎজা নিয়ে আসি। বাসায় এসে দরজা ধাক্কা দিই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেউ দরজা খোলে না। আমার মন অস্থির হয়ে ওঠে, শুধু ঘামছিলাম।”

“কেয়ারটেকারকে বলি- যেভাবে পার দরজা খুলে দাও। পাশের বাসার এক ভাবি আসেন। পরে কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিলে ওই ভাবি বাসায় ঢোকেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দৌড়ে এসে আমাকে বলেন, ‘আপনি ভিতরে যাবেন না, সহ্য করতে পারবেন না’।”

এটুকু বলেই থেমে গেলেন জয়শ্রী; এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন, যেন যক্ষের ধন দুই সন্তানকে খুঁজছেন।

“আমি উঁকি দিয়ে দেখি ছেলেটা ঝুলে আছে। মেয়ের লাশ দেখতে পারিনি। হায়! সকালে ঘুমে থাকা ছেলেটার কপালে চুমু দিয়ে গেছি, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে করেছি আদর।”

সন্তানরা মাদকাসক্ত বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই সাংবাদিক।

“যে সন্তান মায়ের কোলে সব সময় থাকতে চায় এবং থাকত, সে সন্তান কিভাবে মাদক নেয় বলুন। চিরশ্রী এ বছর ‘ও’ লেভেলে চারটি বিষয়ে ‘এ’ প্লাস এবং চারটি বিষয়ে ‘এ’ পেয়েছে। এই বিষয়টি কোনো পত্রিকায় লেখেনি।”

কথায় কথায় স্বামী টিপুর প্রসঙ্গও চলে আসে, যার সঙ্গে সাত বছর আগে বিচ্ছেদ ঘটে জয়শ্রীর।  

“টিপুর সঙ্গে সংসার করেছি চৌদ্দ বছর। টিপুর অনেক দোষ ছিল, কিন্তু তাকে আমি ক্ষমা করতাম এই ভেবে, ছোট বেলায় টিপুর মা মারা গেছেন। কিন্তু অন্য নারীর সঙ্গে প্রেমতো আর ক্ষমা করা যায় না। হয়ে গেল বিচ্ছেদ।”

জানালেন, বিচ্ছেদের পর বড় বোন তিলোত্তমার বাসায় উঠেছিলেন। পরে সেখান থেকে চলে আসেন আরেক বড় বোন ডা. স্বপ্না জামানের বাসায় ।

“কয়েকদিন পর উত্তরায় এক কক্ষের একটি বাসা নিই। টিউশনি করে এবং একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে অল্প বেতনে চাকরি করে কোনো মতে সংসার চালাতাম। ডিম, আলু ভর্তা আর ডাল খেয়েই চলতাম। ভোরের কাগজের পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) চাকরি নিই।”

বাসসের চাকরি স্থায়ী ছিল না জানিয়ে জয়শ্রী বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকজনের চাকরি থাকবে না। আমার নামও সেই তালিকায় ওঠে। বাচ্চারা এটা জানতে পারে এবং আমাকে বলে- মা ডিসেম্বরে চাকরি চলে গেলে আমরা কোথায় যাব?”

জয়শ্রীর বোন তিলোত্তমা জানালেন, কিছুদিন আগে টিপু তার আর মেয়ে চিরশ্রীর ছবি ফেইসবুক থেকে সরিয়ে নতুন সন্তানের ছবি দিয়েছে। এটা দুই ভাইবোন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।

জয়শ্রী দিন কিভাবে কাটান- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কেউ আসলেই তাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে এবং পুরনো স্মৃতিচারণ করতে থাকেন। কিছু খেতে চায় না। জোর করে খাওয়াতে হয়।”

গত মঙ্গলবার রাতে আজিমপুর কবরস্থানে দুই ভাইবোনকে দাফন করা হয়েছে। এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

শুক্রবার বিকালে মোহাম্মদপুরে মিলাদ হবে বলে জানান জয়শ্রী।