কক্সবাজার জেলার সাগর ঘেরা দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের আকবর বলি পাড়ার বাসিন্দা নুরুল কাদের। এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৪৫টি গ্রাম এখন নিয়মিত জোয়ারের পানিতে ভাসে।
বাঁধের ভাঙনে কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ও উত্তরের বিভিন্ন অংশ প্রতিবছর সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গৃহহীন মানুষ পূর্ব পুরুষের ভিটা ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছে কক্সবাজারের অন্যান্য স্থানে, অন্যান্য জেলায়। লবণাক্ততার কারণে চাষের জমিও দিন দিন কমছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ভাঙনের কারণে গত ষাট বছরে এ দ্বীপের প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পুরো দ্বীপ সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দাদের আশঙ্কা। কুতুবদিয়া রক্ষায় একটি স্থায়ী বাঁধের দাবি জানিয়েছেন তারা।
কুতুবদিয়া ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বীপের দক্ষিণের ইউনিয়ন ‘আলী আকবর ডেইল’-এ ভাঙনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এ দ্বীপ ঘিরে দেয়া প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে যায়। এরপর আলী আকবর ডেইলে শুরু হয় ভাঙন। এ ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ড ‘হুজিয়ার টেক’ ২০১২ সালে পুরোপুরি সাগরে বিলীন হয়ে যায়।
স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা শহীদুল্লাহ (৪০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাদার আমল থেকেই দেখছি দ্বীপ শুধু ভাঙে। গত ৩৫ বছরে আমাদের পরিবার চারবার নতুন ঘর করেছে। হুজিয়ার টেক বিলীন হওয়ার পর সর্বশেষ আবদুল হাদি শিকদার পাড়ায় ঘর বানিয়ে আছি।”
আগের সেই হুজিয়ার টেক সংলগ্ন পশ্চিম তাবলর চর, টেক পাড়া, বর্তা কাটা, জেলে পাড়া, কুলিয়া মির্জার বাড়ি ও চরপাড়ায় এখন ভাঙন চলছে। দ্বীপের এ অংশে বাঁধের কোনো অস্তিত্বই চোখে পড়েনি।
ষাটের দশকে নির্মিত আজম খান সড়কই (মূলত মাটির বাঁধ) এখন এসব এলাকার একমাত্র প্রতিরক্ষা।
দ্বীপের উত্তর অংশে উত্তর ধুরুং এর আকবর বলি পাড়া ওয়ার্ড সংলগ্ন অংশে আছে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার মাটির বাঁধ। তাও বিভিন্ন স্থানে ভেঙে দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতার মাটির ঢিবির মতো টিকে আছে।
গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু। ২০০৭-০৮ সালে একবার মেরামত করা হয়েছিল। এখন জোয়ার এলেই বাড়িঘর আর জমিতে পানি ঢুকে যায়।”
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী, খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে সাগরে জেগে ওঠে এই দ্বীপ। তবে মানুষের বসবাস শুরু হয় পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে।
হযরত কুতুবুদ্দীন নামে এক আধ্যাত্মিক পুরুষ এই দ্বীপে আস্তানা গড়েছিলেন বলে লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় ‘কুতুবুদ্দীনের দিয়া’। সেই থেকে দ্বীপের নাম কুতুবদিয়া।
তথ্য বাতায়ন বলছে, ১ লাখ ৩৩ হাজার জনসংখ্যার এই উপজেলার আয়তন এখন ২৭ বর্গ কিলোমিটার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যাণ্ড ফিশারিজের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ১৯৫০ সালের ৭৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপ ২০০৯ সালে এসে ৬৯ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়ায়। এই সময়ে শুধু দ্বীপের দৈর্ঘ্যই কমেছে তিন কিলোমিটার।
“গত কয়েক বছরে এ আয়তন আরও কয়েক বর্গ কিলোমিটার কমেছে। এ ধরনের ডেল্টা আকৃতির দ্বীপ এমনিতেই ভাঙনপ্রবণ। নিয়মিত বিরতিতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় নিরাপত্তার অভাবে ভাঙন আরো বেশি হচ্ছে।”
অধ্যাপক সাইদুর জানান, ১৯৭৯ সালে কুতুবদিয়ায় কৃষি জমি ছিল চার হাজার ৭০০ হেক্টর, লবণ মাঠ ছিল তিনশ হেক্টর।
উপজেলা তথ্য বাতায়নের হিসাব অনুযায়ী, এখন কৃষি জমি আছে তিন হাজার ৫২০ হেক্টর আর লবণ মাঠ এক হাজার ৭৮৮ হেক্টর।
তাবলর চরের বাসিন্দা বর্ষীয়ান লেদু মিয়া বলেন, বর্ষায় যে জমিতে লবণ পানি ঢোকে সেখানে আর কিছু হয় না। পরে লবণ বা চিংড়ি চাষ করতে হয়।
লেমসিখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা জাবের আহমেদের ছয় কানি জমি ছিল। সংসারে অভাব ছিল না। ভাঙনে পড়ে সব হারিয়ে শেষ সম্বল এক কানি জমিও বিক্রি করে দ্বীপ ছাড়েন পাঁচ বছর আগে।
এরপর কক্সবাজারের চকরিয়ার থানার বরইতলীর পাহাড়ের ঢালে ঘর বেঁধেছেন তিনি।
জাবের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষি কাজ করতাম। মাছ ধরার নৌকাও ছিল। সব গেছে।”
শুধু জাবেরের মতো ঘর হারা মানুষই নয়, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কুতুবদিয়ার ভাঙনকবলিত এলাকার হাজার হাজার মানুষ এখন দ্বীপের বাইরে বিকল্প আবাসের খোঁজ করছেন।
আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফিরোজ খান চৌধুরী বলেন, হুজিয়ার টেকে একসময় ভোটার ছিল প্রায় আড়াই হাজার। ২০১১ সালে তা শ’ খানেকে এসে ঠেকে।
“এ জায়গার লোকজন কক্সবাজার সদর, বান্দরবান, চকরিয়া ও পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছে। দ্বীপে যাদের অবস্থা ভাল, তারা অন্য জায়গায় আগেই ঘর তৈরি করে রাখছে।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ইয়ং পাওয়ার সোশ্যাল অ্যাকশন’ এর (ইপসা) ‘হাউজিং ল্যাণ্ড অ্যাণ্ড প্রোপার্টি রাইটস ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের সমন্বয়কারী মো. শাহজাহান বলেন, ১৯৯১ থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এ দ্বীপ ছেড়েছে।
“সরকারের উচিত স্থানচ্যুতদের তথ্য সংগ্রহ করে খাস জমি বরাদ্দের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি ক্লাইমেট রিফিউজিতে পরিণত হওয়া এই সব মানুষের জন্য আর্ন্তজাতিক পর্যায় থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা।”
কুতুবদিয়া ঘিরে থাকা প্রায় ৪০ কিলোমিটার বাঁধের ১৮ কিলোমিটারিই ক্ষতিগ্রস্ত ও অকার্যকর বলে জানালেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে দ্বীপগুলোতেও।
উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী বলেন, “ছোটবেলায় জোয়ারে যে উচ্চতার পানি দেখেছি, এখন তার চেয়ে বেশি দেখি। দ্বীপের একটা বড় অংশ বিলীন হয়ে গেছে। স্থায়ী বাঁধ না হলে কুতুবদিয়াকে রক্ষা করা সম্ভব না। মাটির বাঁধ দিলে বা মেরামত করতে গেলে টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজার অঞ্চলের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (অপারেশনস অ্যান্ড মেনটেইনেন্স) মোফাজ্জল হোসেন বলেন, তাবলর চর সংলগ্ন দ্বীপের দক্ষিণ অংশে এক হাজার একশ মিটার পাকা বাঁধ নির্মাণের জন্য ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ নভেম্বরে শুরু হবে।
“পুরো কুতুবদিয়া রক্ষায় ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। এর কাজ আগামী বছর বা ২০১৬ সালে শুরু হতে পারে।”
তবে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে ভাঙন রোধে প্রাকৃতিক উপকূলীয় বেষ্টনী তৈরি ও পলি জমা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলেও অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম মনে করেন।