তদন্তে গাফিলতিতে সাঈদী পার?

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা আপিলে কমে যাওয়ার জন্য তদন্ত সংস্থার গাফিলতিকে সরাসরি দায়ী করেছেন সর্বোচ্চ আদালতে এই মামলা পরিচালনাকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তন্ময় ইমরানতন্ময় ইমরানজনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2014, 07:55 PM
Updated : 18 Sept 2014, 11:48 AM

তদন্ত প্রক্রিয়ায় ত্রুটির পাশাপাশি এই মামলার সঙ্গে যুক্ত প্রসিকিউটরদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির রায় দিলেও বুধবার আপিলের রায়ে তা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেয় আপিল বিভাগ।

এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে আসা ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিও সাঈদীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে ত্রুটিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কমিটির আহ্বায়ক এম এ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য উপস্থাপনে দুর্বলতা ছিল।

এরপর রাতে একাত্তর টেলিভিশনের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মাহবুবে আলম সরাসরি তদন্ত সংস্থার গাফিলতিকে দায়ী করেন।

এক্ষেত্রে ইব্রাহিম কুট্টির হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার স্ত্রীর করা মামলার এজাহার তদন্ত সংস্থা জোগাড় করতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এই মামলায় তদন্তকারী দলের গাফিলতি ছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার পর তার স্ত্রী যে এজাহার করেছিল, তা খুঁজে পায়নি।

“সাঈদীর আইনজীবী (আদালতে) ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর যে এজাহারটি তুলে ধরেছেন, তাতে সাঈদীর নাম নেই। অথচ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সেটি খুঁজে পায়নি। এমনকি ওই এজাহার ধরে সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা চলেছে কি না, কিংবা পরবর্তীতে তার নাম এসেছে কি না, সেটাও তারা জানেন না।”

ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার জন্য জামায়াত নেতা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনোলের তদন্ত সংস্থার সংন্বয়কারী সানাউল হকের সঙ্গেও কথা বলে একাত্তর টেলিভিশন।  

এজাহারটি পাওয়া যায়নি জানিয়ে সানাউল হক বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলও এজাহারটি উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

“তিনি নিজেও তো বরিশাল-পিরোজপুর গিয়েছিলেন সেই নথি খুঁজে বের করতে, পারেননি তো? ওই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাও বলেছেন, এমন কোনো কাগজ তারা খুঁজে পাননি।”

এর উত্তরে মাহবুবে আলম বলেন, “আমি মনে করি সেই নথিটি ছিল। কারো যোগসাজসে সেটি সরানো হয়েছে, যে কারণে আমরা পাচ্ছি না। এটি পুরোপুরি সমন্বয়হীনতা।”

তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নানও রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড  উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে আশা করে ছিলাম । কিন্ত তা হয়নি। উচ্চ আদালত যে রায়  দিয়েছেন, সেটার ওপর বলার কিছু নাই।”

নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকারে নারাজ সানাউল হক বলেন, “তদন্তকারী দল যখন ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন জমা দেয় , তখন প্রসিকিউটাররাও তো কী কী ঘাটতি আছে, সেটা বলবেন। কিন্তু রায় দেওয়ার পর এখন আমাদের দোষারোপ করা হচ্ছে।

“আমরা তদন্ত কমিটি সবসময়ই কোনো গাফিলতি থাকলে তাদের কাছে জানতে চেয়েছি।”

এই পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল প্রসিকিউটদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, প্রশ্ন তোলে প্রধান প্রসিকিউটরের শারিরীক সামর্থ্য নিয়েও।  প্রসিকিউটরদের বিরোধের কথাও উঠে আসে তার কথায়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মাহবুবে আলম বলেন, “ট্রাইব্যুনালে এমন ঘটনা ঘটছে, যা শুনলে আপনারা শিউরে উঠবেন। প্রসিকিউটরদের মধ্যে এমন লোকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার একটি ফৌজদারি মামলার অভিজ্ঞতাও নেই।

মাহবুবে আলম (ফাইল ছবি)

“কিছুদিন আগে ট্রাইব্যুনালের এইকজন আইনজীবীকে বিচারক বিরক্ত হয়ে বিচারক্ক্ষ থেকে বের করে দিয়েছেন। কারণ উনি এতই উল্টাপাল্টা কথা বলছিলেন।”

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ‘অদক্ষ’ প্রসিকিউটর নিয়োগের জন্য সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে দোষারোপ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রায়ে সাঈদীর পার পেয়ে যাওয়ার জন্য সরাসরি না বললেও প্রসিকিউটিং দলে পরিবর্তন আনার পক্ষে মত জানিয়েছেন।

প্রসিকিউশনের কোনো দুর্বলতা ছিল কি না- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না দেখে কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। তবে প্রসিকিউশন টিমের যা অবস্থা, সেখানে পরিবর্তন আসা উচিৎ।”

প্রসিকিউটদের বিরোধের বিষয়টি নয় মাস আগে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া আনিসুল হকেরও জানা। বিরোধ নিষ্পত্তিতে হস্তক্ষেপও করতে হয়েছিল তাকে। 

তিনি বলেন, “ট্রাইব্যুনালে কিছু কিছু মামলা চলছে, কিছু রায় অপেক্ষমাণ আছে। প্রসিকিউশন টিমের যেন কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য আমি কোনো পরিবর্তন আনিনি। তবে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

জামায়াতের নায়েবে আমির সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড এড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আঁতাতের যে অভিযোগ গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ থেকে করা হচ্ছে, তা নাকচ করেছেন আইনমন্ত্রীর পাশাপাশি অ্যাটর্নি জেনারেলও।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাউন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক হাসান সবমিলিয়ে সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, “প্রয়োজনীয় দলিলাদি উপস্থাপনে দুর্বলতা, সাক্ষী সুরক্ষা না হওয়া ও আঁতাতের গুজবে মানুষের মধ্যে এক ধরনের পারসেপশান তৈরি হয়েছে। যেটা কখনো ভালো নয়।”

আপিলের রায়ে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্যাটেজি ফোরামও (আইসিএসএফ)। 

সাঈদীর দণ্ড মওকুফের সুযোগ বন্ধ করতে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি, যে অনুচ্ছেদ বলে রাষ্ট্রপতি যে কাউকে ক্ষমা করতে পারেন।