সাঈদীর রায় প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগে সমাবেশের ডাক

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলে সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে শুক্রবার শাহবাগে সমাবেশের ডাক দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2014, 01:06 PM
Updated : 17 Sept 2014, 07:37 PM

বুধবার সকালে আপিলের রায়ের আগেই শাহবাগে অবস্থান নিয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবির আন্দোলনকারীরা। দুপুরে রায়ের পর তারা ক্ষুব্ধ হয়ে সড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের হটিয়ে দেওয়ার পর বিকালে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

পুলিশের কাঁদুনে গ্যাসে আহত মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার উপস্থিত থাকতে না পারায় ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন ব্লগার আরিফ জেবতিক।

মঞ্চের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান এবং বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় শাহবাগসহ সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায়েএকাত্তরে নির্যাতিত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার ভেতরে থাকা ক্ষোভ উগরে দেন।

“আমি মনে প্রাণে ক্ষুব্ধ।আজকে নতুন প্রজন্মের মতো গরম বক্তৃতা আমি দিতে পারছি না, কিন্তু আমার ধমনীতে যে গরম রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তা হয়ত আপনাদের বোঝাতে পারছি না।”

মঞ্চকর্মীদের ওপর পুলিশি হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা ৪০ বছর ধরে রাজাকার ও যুদ্ধপরাধীদের অভিশাপ বুকে বহন করে চলেছি, বুকের ভেতরে জং ধরে গেছে, অনেকটা পথ এসে গণজাগরণ মঞ্চ বড় ঠিকানা হয়ে উঠেছে আমাদের। তারা আমাদের আশ্রয়।

“কিন্তু যে তরুণরা একটা মহৎ দাবি নিয়ে এখানে এসেছে, তাদের ওপর পুলিশ হামলা করল আমি এর প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি।”

রায়ের আগে শাহবাগে ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে সমবেত গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা সাঈদীর আপিলের রায়ে সাজা কমে এলে দুপুরে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা।

এর এক পর্যায়ে তাদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। এতে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরানসহ কয়েকজন কর্মী আহত হন।

যাদের আন্দোলনে এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতারা একাত্মতা জানিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের এই পদেক্ষেপের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলেও সড়ক আটকানো তারা মেনে নিতে পারেন না।

সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, “আমি তার কঠোরতম শাস্তি চাই, যেমন করে কাদের মোল্লার শাস্তি হয়েছিল।যুদ্ধসময়ে সাঈদীরা হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, মা-বোনদের ইজ্জত নিয়েছে।নিঃসঙ্গ করেছে একেকটি পরিবারকে। তারা এসব করার সময় এতা আইন আদালত বসায়নি, বয়সের চিন্তা করেনি।”

মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক বলেন, “এই রায়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি আমরা।এই প্রত্যাখ্যানের জন্য আমাদের যদি দেশদ্রোহীও হতে হয়, তাতেও রাজি আছি।”

তিনি দাবি করেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কৌশলগত আঁতাতের ফলই হল এই রায়।

মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার মারুফ রসুলের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন যুব ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন, সাবেক ছাত্রনেতা বাকী বিল্লাহ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক তাহমিনা সুলতানা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাবিব, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর আহ্বায়ক ফয়সাল ফারুক অভী, মঞ্চের কর্মী সাহিদা সুলতানা অ্যানি, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম সম্পাদক জলি তালুকদার এবং মঞ্চের কর্মী শিবলী হাসান।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পর তার ফাঁসির দাবিতে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে গড়ে উঠে শাহবাগের আন্দোলন, যা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে পরিচিতি পায়।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গত বছর শাহবাগে এক সমাবেশ (ফাইল ছবি)

তখন প্রায় এক মাস শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায় তারা। তখন পুলিশের পক্ষ থেকেও তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্যেই আইন সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিল করার সুযোগ দেয়া হয়। আপিলের রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হলে গত বছরের ডিসেম্বরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

সমঝোতার ক্ষীণ আশা মিইয়ে গেল সন্ধ্যায়

কয়েক মাস আগে ইমরানদের ওপর হামলার পর গণজাগরণ মঞ্চে বিভক্তি দেখা দেয়। কামাল পাশা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন একটি অংশ আলাদাভাবে কর্মসূচি করছিল।  

বুধবার সাঈদীর চূড়ান্ত রায়ের পর ঐক্যবদ্ধ হওয়া নিয়ে দফায় দফায় আলাপ-আলোচনাও চলে দুই পক্ষে, উভয়পক্ষের সংগঠকদের মধ্য থেকে সমঝোতার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই সমঝোতা হয়নি।

ইমরান নেতৃত্বাধীনদের সমাবেশে আরিফ জেবতিকসহ কয়েকজন বক্তা কামাল পাশা অংশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন।

কামাল পাশাদের উদ্দেশ করে খান আসাদুজ্জামান মাসুম বলেন, “ডিজিটাল মাইকে গান-বাজনা চালিয়ে এবং সরকারের অধীনস্ত থেকে আন্দোলন হবে না। জনগণের অধিকার আদায়ের কঠোর আন্দোলনে শামিল হতে হবে।”

অন্যদিকে কামাল পাশা চৌধুরী অংশের সমাবেশে এফএম শাহীন বলেন, “আমাদের পার্শ্ববর্তী একটা অংশ ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এদের থেকে জনগণকে সচেতন হতে হবে।”

শাহবাগে কামাল পাশা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চের মিছিল।

কামাল পাশা নেতৃত্বাধীন অংশের নেতা-কর্মীরা সকাল ১১টার দিকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসে অবস্থান নেয়। শাহবাগ মোড়ে ছিল ইমরান নেতৃত্বাধীনরা।

ইমরানদের ওপর যখন পুলিশ চড়াও হয়, তখন এদিক থেকে কোনো নেতাকর্মী যাতে মোড়ের দিকে না যায়, মাইকে সেই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল।

সাঈদীর রায় প্রত্যাখ্যান করলেও তারা সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো আন্দোলন করবে না বলে জানায়।

এদিকে সাঈদীর রায় প্রত্যাখ্যান করে তা পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ।

দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিল টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে শেষ হয়।

সমাবেশে বক্তব্য দেন ছাত্রলীগ সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফ।