তিন অপরাধে সাঈদীর আমৃত্যু কারাবাস

আপিল বিভাগের রায়ে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালী হত্যায় মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেলেও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও নারী অপহরণ করে ধর্ষণে সহায়তার দায়ে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া’ পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2014, 12:19 PM
Updated : 31 Dec 2015, 05:26 AM

প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বুধবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করে।

এর মধ্যে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন।

তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলায় হত্যা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার দুটি ঘটনায় সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাশাপাশি আরো ছয় অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছিল।

এই রায়ের বিরুদ্ধে উভয়পক্ষের আপিল শুনানি করে উভয়টির আংশিক মঞ্জুর করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

আপিলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করা এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার মতো অপরাধে সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

যাবজ্জীবন বলতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পর্যন্ত’ কারাবাস বোঝাবে বলে রায়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।

এই তিন অপরাধের মধ্যে ১০ নম্বর অভিযোগে বিসাবালীকে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

ট্রাইব্যুনাল ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিলেও আপিল বিভাগ অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে।

এছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সহযোগিতার জন্য ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।

১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও অন্য দুই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় এ দুই ঘটনায় কোনো সাজার উল্লেখ করেনি। ৬, ৭, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগেও একই রায় এসেছিল ট্রাইব্যুনালে।

এই ছয় অপরাধে শাস্তি স্পষ্ট করতে আপিল বিভাগে আবেদন করেছিল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।

আর ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগে প্রমাণিত হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ এসব অভিযোগে আপিল বিভাগের কাছে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ন্যায়বিচার’ প্রার্থনা করে। 

আমৃত্যু দণ্ডের তিন অপরাধ

অভিযোগ-১০:  ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যার মধ্যে রয়েছে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল মণ্ডল, বিসাবালি, সুকাবালি, সতিশবালার ঘর। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিসাবালীকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে।

অভিযোগ-১৬:  স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোনকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। সেখানে তাদের আটকে রেখে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।

অভিযোগ-১৯: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদী জোর করে মধুসুদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, ডা. গণেশ সাহা, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, শান্তি রায়, হরি রায় জুরান, ফকির দাস, টোনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা, হরিদাস, গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কামাল রাণীসহ ১০০/১৫০ জন হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেন।

সাজা কমেছে দুই অপরাধে

আপিলের রায়ে সাঈদীকে দেয়া ট্রাইব্যুনালের সাজা কমেছে দুই অপরাধে। এরমধ্যে ১০ নম্বর অপরাধে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আর ৮ নম্বর অভিযোগে দুই অংশকে আলাদাভাবে বিবেচনায় নিয়ে একাংশের জন্য তাকে ১২ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপর অংশ থেকে খালাস পেয়েছেন সাঈদী।

এর একাংশে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা এবং অপর অংশে পারেরহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া কথা রয়েছে। তবে কোন অংশে তাকে খালাস এবং কোন অংশে তার ১২ বছরের দণ্ড হয়েছে, তা সংক্ষিপ্ত রায়ে স্পষ্ট হয়নি।

ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

অভিযোগ-৮:
একাত্তরের ৮ মে বেলা ৩টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সাঙ্গপাঙ্গরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় সদর থানার চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহিমকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেনা ক্যাম্পে ফেরার পথে সাঈদীর প্ররোচনায় ইব্রাহিমকে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়া হয়। আর মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে করা হয় নির্যাতন। পরে সাঈদী ও অন্যদের দেয়া আগুনে পারের হাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

খালাস তিন অপরাধে

ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হলেও সাজার উল্লেখ না থাকা ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দিয়েছে আপিল বিভাগ। একাত্তরে হামলা, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় এসব অভিযোগ আনা হয়েছিল। 

অভিযোগ-৬: ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একদল সদস্য পিরোজপুর সদরের পারেরহাটে গিয়ে পাকিস্তানী সেনা সদস্যদের ওই এলাকায় নিয়ে আসে। তাদের পারেরহাট বাজারে নিয়ে এসে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকান-পাট চিনিয়ে দেন সাঈদী। পরে সাঈদী অন্যদের সঙ্গে বাড়ি ও দোকানে হানা দিয়ে মূল্যবান সম্পদ লুট করেন। যার মধ্যে মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকেই বাইশ সের স্বর্ণ ও রৌপ্যও লুট করা হয়।

অভিযোগ-১১: মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ২ জুন সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা ইন্দুরকানি থানার টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন এবং নগদ টাকা, অলঙ্কার ও মূল্যবান সামগ্রী লুটপাট করা হয়।

অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এক সকালে সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর ৫০-৬০ জন সদস্য সদর থানার হোগলাবুনিয়ায় হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে সাঈদীর উপস্থিতিতে শেফালী ঘরামিকে ধর্ষণ করা হয়। পরে তারা ওই হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের যুক্তি

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপক্ষের ৭ নম্বর সাক্ষী মফিজ উদ্দিন পসারী ৮ নম্বর অভিযোগের ঘটনায় ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। রাজাকার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ভাগ্যক্রমে তিনি জীবন বাঁচাতে পেরেছিলেন।

আর প্রসিকিউশনের পাঁচ নম্বর সাক্ষী মাহতাবউদ্দিন হাওলাদার ও নয় নম্বর সাক্ষী আলতাফ হোসেন হাওলাদার ১০ নম্বর অভিযোগের ঘটনায় বিসাবালীকে হত্যা ও উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়ার প্রত্যক্ষদর্শী। 

আপিল শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “আশা করি দুটি অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকবে এবং পাশাপাশি প্রমাণিত বাকি ৬ অপরাধেও শাস্তি দেয়া হবে।”

অন্যদিকে সাঈদীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, “দুটি চার্জে সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগে যে স্থান ও সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তা প্রকৃত স্থান ও সময়ের সম্পূর্ণ বিপরীত।”

বিসাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালীর বক্তব্য ট্রাইব্যুনালে দেয়া হয়েছে জানিয়ে মাহবুব বলেন, “তিনি (সুখরঞ্জন) ট্রাইব্যুনালে এসে মিথ্যা সাক্ষী দিতে চাননি। তিনি আমাদের পক্ষে সাক্ষী দিতে চেয়েছেন। আমরা তাকে নিয়েও এসেছিলাম। কিন্তু সাদা পোশাকে তাকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করা হয়। সত্য কথা বলতে গিয়ে তিনি আজ ভারতে কারাগারে বন্দি।”