সাজা কমিয়ে সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।

সুলাইমান নিলয়ও আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2014, 04:16 AM
Updated : 17 Sept 2014, 04:50 PM

প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বুধবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করে।

এর মধ্যে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন।

তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।

আপিলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন বলতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পর্যন্ত’ কারাবাস বোঝাবে বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।

এছাড়া ৮ নম্বর অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৭ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।

এই মামলায় সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষের দুটি আপিল ছিল। আদালত উভয়টির আংশিক মঞ্জুর করেছে।

এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল।

একাত্তরে ভূমিকার কারণে ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমানোর রায় আসায় তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা  বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

শাহবাগে শ্লোগান ওঠে - ‘আঁতাতের এই রায় মানি না, প্রহসনের এই রায় মানি না’।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই জামায়াত নেতার ছেলে মাসুদ সাঈদী ও আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, তারা খালাস আশা করেছিলেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলে পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন। 

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা প্রত্যাশিত রায় পাননি। তবে এই রায়েও ‘ধর্মীয় নেতা’ হিসাবে সাঈদীর মুখোশ খুলে গেছে।

রায়ে ‘মর্মাহত’ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কি না- সে বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্পষ্ট কিছু বলেননি।

এদিকে রায়ের প্রতিবাদে সাঈদীর মুক্তির দাবিতে বৃহস্পতি ও রোববার দুই দফায় ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে তার দল জামায়াতে ইসলামী, যে দলটির বিরুদ্ধেও একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। 

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে সাঈদী হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হলো। এর আগে তার দলেরই নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তির পর গত বছরের ডিসেম্বর তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীর বিচার শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ওই রায়ের পর দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। ওই তাণ্ডবে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন অন্তত ৭০ জন। এছাড়া বহু গাড়ি-দোকানপাট ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়।

ওই বিষয়টি মাথায় রেখে মঙ্গলবার রাত থেকেই সারা দেশে ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি নেয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয় বিজিবি।

বুধবার সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের ফটকে মোতায়েন করা হয় পুলিশ ও র‌্যাব। সাংবাদিক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের তল্লাশি করে আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেয়া হয়।

 

তিন অপরাধে আমৃত্যু দণ্ড

সকাল ৯টায় আদালত বসার কথা কার্যতালিকায় থাকলেও বিচারকরা এজলাসে আসেন সকাল ১০টায়। তার আগেই সর্বোচ্চ আদালতের ১ নম্বর এজলাস কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। 

প্রায় পাঁচ শতাধিক আইনজীবী ও সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ৫ মিনিটেই রায় পড়া শেষ করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন।

তিনি বলেন, আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছে।  

আপিলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করা এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার মতো অপরাধে সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

এই তিন অপরাধের মধ্যে ১০ নম্বর অভিযোগে বিসাবালীকে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

ট্রাইব্যুনাল ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিলেও আপিল বিভাগ অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্য অংশের জন্য খালাস দিয়েছে।

এছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সহযোগিতার জন্য ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।

১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও অন্য দুই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় এ দুই ঘটনায় কোনো সাজার উল্লেখ করেনি। ৬, ৭, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগেও একই রায় এসেছিল ট্রাইব্যুনালে।

এই ছয় অপরাধে শাস্তি স্পষ্ট করতে আপিল বিভাগে আবেদন করেছিল ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। আপিলের রায়ে ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন সাঈদী।

আর ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগে প্রমাণিত হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ এসব অভিযোগে আপিল বিভাগের কাছে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ন্যায়বিচার’ প্রার্থনা করেছিল। আপিলের সংক্ষিপ্ত রায়ে এসব অভিযোগের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। 

রায়ে ‘হতাশা’

রায়ের পর নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “সর্বোচ্চ আদালতের যে কোনো আদেশ ও রায়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মানবতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা আশা করি, সেটা না হওয়ায় আমি মর্মাহত।”

এ মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কোনো দুর্বলতা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না দেখে কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। তবে প্রসিকিউশন টিমের যা অবস্থা, সেখানে পরিবর্তন আসা উচিৎ।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল মৃত্যুদণ্ড। ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছিল তা বহাল থাকবে এটাই ছিল প্রত্যাশা। সেটা থাকেনি। আমার খুব খারাপ লাগছে।”

তবে আপিল বিভাগের রায়ের পর ‘ধর্মীয় নেতা’ হিসাবে সাঈদীর মুখোশ খুলে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাইনি। হাতে পেলে বুঝতে পারব কোন কোন জায়গায় আরো তথ্য প্রমাণ প্রয়োজন ছিল।”

সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, তারা এ রায়ের সঙ্গে একমত হতে পারেননি।

এই জামায়াত নেতার ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল নির্দোষ প্রমাণ হয়ে বেকসুর খালাসের রায় পাব। আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর রিভিউ আবেদন করব।”

এদিকে রায় জানার সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়া গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ঘণ্টাখানেক পর কাঁদুনে গ্যাস ও গরম জল ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁতাত করে এই রায় দেয়া হয়েছে। এটা পরিকল্পিত, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক।”

এ অভিযোগ অস্বীকার করে ১৪ দল সমন্বয়ক ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “আঁতাতের প্রশ্নই আসে না। বিচার বিভাগের উপরে হস্তক্ষেপ শোভন নয়।”

রায়ের পর তার প্রতিবাদে আদালতের বাইরে ফাঁসির দড়ি হাতে বিক্ষোভে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা। 

রায়ে হতাশা প্রকাশ করে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান কে এম শফিউল্লাহ বলেন, এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।

অন্যদিকে সাঈদীর মুক্তির দাবিতে বৃহস্পতি ও রোববার সারা দেশে হরতাল ডেকেছে সাঈদীর দল জামায়াতে ইসলামী।

দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে বলেন, “বারবার তিনি (সাঈদী ) এ সরকারের চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরকারের সাজানো মিথ্যা মামলায় আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও তিনি ন্যায় বিচার বঞ্চিত হয়ে চরম জুলুমের শিকার হলেন।”

৪৯ ধারার সংশোধন দাবি

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিলে তা বহাল না থাকার কারণ হিসেবে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি।

কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, “বিচারের ক্ষেত্রে তথ্য উপস্থাপনের দুর্বলতা আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। সঠিকভাবে তারা আমাদের সাহায্যও নেয়নি।”

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) রায়ে হতাশা প্রকাশের পাশাপাশি সাঈদীর দণ্ড মওকুফের সুযোগ বন্ধ করতে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।

৪৯ ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দেয়া যে কোনো দণ্ডের মার্জনা বা মওকুফ করার ক্ষমতা রাখেন।

রিভিউ জটিলতা

যুদ্ধাপরাধ মামলায় আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটি রায়ের পূর্ণ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় এ বিষয়ে অস্পষ্টতা কাটেনি নয় মাসেও।

এর আগে ফাঁসির রায় কার্যকরের উদ্যোগের মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর ‘রিভিউ’ আবেদন করেন কাদের মোল্লা। ফলে শেষ মুহূর্তে রায় কার্যকর ঝুলে যায়।

এরপর কাদের মোল্লার আবেদন খারিজ হয়। তার ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। কিন্তু এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘রিভিউ’ আবেদন গ্রহণযোগ্য কি না- তা জানা যায়নি ওই রায়ের পূর্ণ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়া কারণে।

রাষ্ট্রপক্ষ এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কি না জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমি আগে বলেছি এখানে রিভিউ চলবে না। এখন তো অন্য কথা বলতে পারি না। একটি বিশেষ আইনের অধীনে এ রায় হয়েছে। এখানে রিভিউয়ের কোনো সুযোগ নেই।”

তবে আদালত পুনর্বিবেচনার সুযোগ দিলে রাষ্ট্রপক্ষ তা করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের আগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

মামলার পূর্বাপর

মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে একাত্তরে জামায়াত নেতা সাঈদীকে পিরোজপুরের মানুষ চিনত ‘দেইল্লা  রাজাকার’ নামে। তিনি যে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় অংশ নিয়েছেন, প্রসিকিউশন তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য সাঈদীকে। পরের বছর ১৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াত নেতাদের মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধেই সবার আগে অভিযোগ গঠন হয়। একাত্তরে ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর ও ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০টি ঘটনায় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

রাষ্ট্রপক্ষে ২৮ জন এবং আসামিপক্ষে ১৭ জনের সাক্ষ্য শুনে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৮ মার্চ আপিল করেন সাঈদী। অন্যদিকে প্রমাণিত হলেও সাজা না হওয়া ছয় অভিযোগে এই জামায়াত নেতার শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

দুই পক্ষের আপিল আবেদনের শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল তা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে আপিল বিভাগ। তার পাঁচ মাস পর বুধবার এই ঘোষণা করা হলো।

৭৪ বছর বয়সী সাঈদী বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে কারাবন্দি তিনি।

তবে এর মধ্যে মা ও ছেলের মৃত্যুর পর দুই দফায় কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন পিরোজপুর থেকে দুই বার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর একে একে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় তাদের, চলতে থাকে বিচার।

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম রায়ে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি।

এর পরের মাসের ৫ তারিখে দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আপিল শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১২ ডিসেম্বর ওই দণ্ড কার্যকর হয়।

ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের আজীবন কারাদণ্ড হয়। মৃত্যুদণ্ড হয় দলটির নেতা আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামানের।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সুমন মাহবুব, মঈনুল হক চৌধুরী, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, কামাল তালুকদার, সাজিদুল হক, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম, ফারহান ফেরদৌস, সুজন মণ্ডল, আজিজ হাসান, মাহবুবা আকতার ডিনা, নাহিদ আশরাফী, মাহামুদ মুরাদ, নাদিয়া চৌধুরী এবং আলোকচিত্রী আসাদুজ্জামান প্রামানিক, তানভীর আহম্মেদ, নয়ন কুমার]