ভূমি দখল: ভিটে-বাড়ি ছাড়ছে রাখাইনরা

দখলদারদের নির্যাতনে পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাখাইনরা ভিটে-মাটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন এ সম্প্রদায়ের লোকেরা।

আশিক হোসেন বরগুনা ও পটুয়াখালী থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2014, 04:51 PM
Updated : 16 Sept 2014, 04:51 PM

কয়েক দশক আগেও বৃহত্তর বরিশাল জেলার পটুয়াখালী ও বরগুনার কয়েকটি এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিলেন রাখাইনরা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বাড়ার বদলে কমে ১৫ ভাগের এক ভাগে দাঁড়িয়েছে তাদের সংখ্যা।  

“এক সময় এ অঞ্চলে আমরাই ছিলাম। পরে বাঙালীরা আসলো, তারা আমাদের জমিজমা নিয়ে গেল। মন্দির আর শ্মশানের জমিও রক্ষা পেল না। এখন যে অবস্থায় আছি, আগামী ৫ থেকে ১০ বছর পরে হয়তো আমাদের কথা শুধু বইতেই পাওয়া যাবে,” বলেন কুয়াকাটার আলীপুর এলাকার রাখাইন কৃষক উথা চিন।

তিনি বলেন, প্রায় ১৫০ বছর ধরে পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস। কিন্তু পরে সেখানে বসতি স্থাপনকারীদের দাপটে ভূমির উপর অধিকার রাখতে পারছেন না তারা।

“এ কারণে ভূমি দস্যুদের আগ্রাসনে উপাসনালয়, শ্মশান ও বসত ভিটে হারিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন রাখাইনরা।”

সরকারি কোনো পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে তৎকালীন বরিশাল জেলায় (পটুয়াখালী ও বরগুনায়) ২৩৭টি রাখাইন গ্রামে বসতির সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার।

সে সময় বরগুনায় ৯৩টি রাখাইন গ্রামের জায়গায় বর্তমানে আছে ১৩টি গ্রাম। এ জেলায় রাখাইনের সংখ্যা এখন এক হাজার ২৫১ জন। আর পটুয়াখালীতে ১৪৪টি গ্রামের জায়গায় এখন ২৬টি গ্রামে থাকছেন এক হাজার ১৭৪ জন রাখাইন।

পটুয়াখালী বুদ্ধিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উথা চিন বলেন, রাখাইনরা মূলত কৃষিকাজ ও তাঁত বুনে জীবিকা চালায়। এখন জমি না থাকায় কৃষিও নাই।দিন মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।

এই পরিস্থিতিতে কোনো রকমে জীবন চালাতে হিমশিম খান রাখাইনরা। এরপরে ভূমি দস্যুদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমান তারা।

জমি সংক্রান্ত মামলা চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন কুয়াকাটার আমখোলা পাড়ার বাসিন্দা তেন নান রাখাইন।

“এলাকার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বারাক মোল্লা আমার তিন একর জমি দখল করে রেখেছে। আমার নামে একটি চাঁদাবাজিসহ ৫টি মামলা করা হয়েছে। আমি গরীব মানুষ, আমার সব সম্পত্তি দখল করে আমাকে দেশ ছাড়া করতে এমনটা করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বারাক মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দখলদারদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে সব খুইয়েছেন ওই এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ মংখুই রাখাইন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি মামলা চালাতে গিয়ে বাকী জমিও বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। আমার যা ছিলো সব শেষ।”

এদের মতো একই পরিস্থিতিতে রয়েছেন বরগুণার তালতলী উপজেলার মনুখে পাড়ার বাসিন্দা উখান, অংকুজান পাড়ার মং মং লান, ছাতন পাড়ার খেই খেই ওয়াই, এমেন মো।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া এলাকার রাখাইনরাও রয়েছেন একই সমস্যায়।

তালতলীর কবিরাজ পাড়ার রাখাইনদের নেতা ধনু শে বলেন, “জায়গা জমি বেদখল হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক রাখাইনই এলাকা ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা আরাকানে (মিয়ানমার) চলে গেছে। রাখাইনদের দুর্বলতার সুযোগে কাগজ তৈরি করে বাঙালীরা বিষয়-সম্পত্তি সব হাতিয়ে নিচ্ছে।

“এ এলাকায় প্রত্যেকটি রাখাইন পুরুষের নামে জমি সংক্রান্ত ৩/৪টি মামলা আছে। বাঙালীরা জমি দখল করে তাতে ফসল ফলিয়ে সে টাকা দিয়ে মামলা চালায় আর রাখাইনরা তা পারে না। ফলে অনেক সময় অন্য জমি বিক্রি করে মামলা চালাতে হয়।”

বাদ যায়নি মন্দির- শ্মশানও

পটুয়াখালী বুদ্ধিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উথা চিন জানান, রাখাইন বসতিপূর্ণ এলাকাটি কাগজে-কলমে আলিপুর নামে পরিচিত হলেও রাখাইনরা একে কালাচাঁদপুর নামেই ডাকেন।

এলাকাটি এক সময় রাখাইন অধ্যুষিত হলেও এখন মাত্র কয়েক ঘর রাখাইন পরিবার বাস করছে। এলাকায় ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি সংরক্ষিত পুকুর, যার বেশিরভাগ অংশ দখল হয়ে এখন একটি বাজার গড়ে উঠেছে।

উথা চিন বলেন, বাজারের উল্টোপাশে একটি রাখাইন শ্মশান রয়েছে, যার প্রায় পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে।

“এখানে ২৭ শতাংশ জায়গা ছিল। এখন মাত্র ৪ শতাংশের মতো আছে, এটিও বেশিদিন রাখা যাবে না।”

এলাকার প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের অবস্থা আরো করুন। দূর থেকে দেখলে মনে হবে হয়তো কোন গো চারণ ভূমি। বৌদ্ধমূর্তি রাখার জন্য বেদী থাকলেও তাতে বিগ্রহ নেই।

নয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু ওপায়া সুন্দ্রা মাথেরো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাখাইনরা দেবতা ছাড়া থাকতে পারেন না। যেহেতু কিয়াং (রাখাইন বিহার) বেদখল হয়ে গেছে এ কারণে তারা এলাকা ছেড়ে গেছে।”

বিহারের একটি লম্বা স্থাপনা দেখিয়ে তিনি বলেন, “এখন চলছে ২৫৫৬ বুদ্ধাব্দ, ২৫০০ বুদ্ধাব্দকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রায় ৫০ বছর আগে এই বুদ্ধাব্দ পিলার তৈরি করা হয়।”

বিহারটিতে একটি বিসর্জিত শয়নকৃত বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। এর ঠিক পেছনেই তোলা হয়েছে দুটি টিনের ঘর। আর বৌদ্ধ মূর্তি রাখার বেদী লাগোয়া করে টিন দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে।

ভিক্ষু মাথেরো বলেন, “প্রশাসনকে বহুবার এটি দখলমুক্ত করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।”

পটুয়াখালী জেলা রাখাইন সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি উ সুয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদিবাসীদের জন্য যে ভূমি আইন রয়েছে তা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণেই এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এখন রাখাইনরা যদি উপাসনা করতে না পারে, মৃতদেহ সৎকার করতে না পারে তাহলে তারা তো চলেই যাবে।

“আমার ভয় হয়, হয়তো রাখাইনদের এ মাটি থেকে উৎখাত করতে এ ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার যদি আমাদের সমস্যার দিকে নজর না দেয় আমরা এখানে টিকতে পারবো না।”

‘সেটেলমেন্টের চেষ্টা’

রাখাইনদের জমি বেদখল হওয়ার বিষয়গুলো পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসনের দৃষ্টিতে আনা হলে জানানো হয়, জমি সেটেলমেন্ট করার চেষ্টা করছেন তারা।

জেলার এডিসি (রেভিন্যু) দেলোয়ার হোসেন মাতব্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত ১৯৬৩ সালের সাইক্লোনে এলাকার ভূমি অফিসে থাকা ভূমি সংক্রান্ত রেকর্ড নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে একটি সুযোগ সন্ধানী মহল অনেক দিন ধরে রাখাইনদের জমি দখল করে আসছে।

“এক্ষেত্রে যেটা মূল সমস্যা তা হচ্ছে দখলদাররা অনেক সময় জাল দলিল তৈরি করে, যেটার নিষ্পত্তি জেলা প্রশাসনের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। এগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আদালত। তবে আমরা এ জমি সংক্রান্ত বিষয়গুলো একটি সেটেলমেন্টে আনার চেষ্টা করছি।”

এ প্রক্রিয়া কতদিন নাগাদ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের লোকবলের কিছু ঘাটতি রয়েছে। পুরো জেলায় সার্ভেয়ার মাত্র দুজন। এ মুহূর্তে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প চলছে যার কারণে একটু সময় লাগছে।”