প্রস্তাবনা ছেঁটে সংবিধান সংশোধন বিলের প্রতিবেদন সংসদে

বিচারপতিদের সরানোর ক্ষমতা আইন প্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে আনতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিলের ওপর সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2014, 02:05 PM
Updated : 14 Sept 2014, 04:02 PM

সংসদীয় কমিটি বহুল আলোচিত এই বিলের ‘দীর্ঘ’ প্রস্তাবনা বাদ দিয়েছে এবং উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছে।

রোববার বিলের প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

গত ৭ সেপ্টেম্বর সংসদে উত্থাপনের পর ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়ে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল।

সংসদের চলতি তৃতীয় অধিবেশনেই বিলটি পাসের প্রস্তুতি চলছে। বিএনপির পাশাপাশি আইনজীবীদের অনেকেই সংবিধান সংশোধনের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। 

সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান সংশোধনের এই উদ্যোগ নিয়েছে।

বিলের ওপর প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সুরঞ্জিত বলেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, কেবল ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চেতনায় ফিরে যাওয়ার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়েছে।

“তারপরও দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, একটি মহল অভিশংসন শব্দটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এনে শব্দ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই।”

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বিচারপতি অপসারণের পদ্ধতি পরিবর্তনের বিরোধিতা করছেন।

এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছাড়লেও প্রথম সংসদের সদস্য আমীর এখনো আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতা হিসেবে পরিচিত।

তাদের বিরোধিতার দিকে ইঙ্গিত করে ৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে তাদের সহকর্মী সুরঞ্জিত বলেন, “যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমর্থন করেন এবং যারা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করেন, তারা সব একাকার হয়ে গেল।

“কোথায় সুপ্রিম কোর্টকে আরও সম্মানিত ও স্বাধীন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিবেন, তা না করে গেল গেল করছেন।”

১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ ও তাদের সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।

চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।

এখন পুনরায় সংবিধান সংশোধন করে আইন প্রণেতাদের হাতে ক্ষমতা নেওয়া হচ্ছে।

সুরঞ্জিত বলেন, “রাষ্ট্রের সমস্ত অঙ্গের দায়বদ্ধতা যেন সবার কাছে থাকে সেজন্য এই বিল।

“বস্তুত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত ও অপসারিত হয়ে থাকেন। শুধু প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে কোনো বিচারককে অপসারণের প্রয়োজন দেখা দিলে এ সংক্রান্ত আইনে গঠিত কমিটি উহা অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠাবে।”

“জাতীয় সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা অনুমোদন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠাবে। এ বিধানটিই বর্তমান বিলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।”

এই সংক্রান্ত আইন সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পাস হওয়ার তিন মাসের মধ্যে করা হবে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।

সংসদীয় কমিটিতে পরিবর্তন

সংসদে উত্থাপিত বিলের প্রস্তাবনাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে যাওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা ছিল, তা বাদ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি।

সংসদীয় কমিটিরে প্রস্তাবে, কোনো বিচারপতির অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে ‘তদন্ত ও প্রমাণ’ আইন করে সংসদ নিয়ন্ত্রণ করার শর্ত রাখা হয়েছে।

সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা ছিল “... এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিবেন।”

সংসদীয় কমিটি এই দফা পরিবর্তন করে বলেছে, “... সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।”

এছাড়া উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে পরবির্তন এনে বলা হয়েছে, “... বিলের ৩ দফার বিধান অনুযায়ী কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। সুতরাং উক্ত আইনে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকিবে না।”

সংসদীয় কমিটি এটি বাদ দিয়ে প্রস্তাবনাতে বলেছে, “যেহেতু নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্যসমূহ পূরণকল্পে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধিকতর সংশোধন সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল।”