‘সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতেই নীতিমালা’

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হবে বলেই মত এসেছে সম্পাদক পরিষদের আলোচনা সভায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2014, 04:18 PM
Updated : 30 August 2014, 04:53 PM

সদ্যপ্রণীত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এই মত প্রকাশ করেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অধিকাংশ সম্পাদক।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও এই নীতিমালার বিরোধিতা করে তা পর্যালোচনা করতে সরকারকে পরামর্শ দেন।

তবে অনুষ্ঠানে কয়েকজন আলোচক ‘অপসাংবাদিকতা’ রোধে সংবাদ মাধ্যমের জন্য নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন।

সরকার সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের পর থেকে তার সমালোচনা হচ্ছে সাংবাদিকদের মধ্য থেকে। তবে তথ্যমন্ত্রী বলছেন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ এই নীতিমালার উদ্দেশ্য নয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়াও বলেন, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ নয়, এর বিকাশের জন্যই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

সভায় সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’কে সম্পাদকদের ‘নিরস্ত্র করার অভিনব প্রয়াস’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

“সরকার বলছে, নীতিমালার বিষয়টি সাংবাদিকদের প্রস্তাব থেকেই আনা হয়েছিল। এটা সত্য, কিন্তু সাংবাদিকদের দাবি ছিল একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন সেই নীতিমালা তৈরি করবে এবং নীতিমালা তৈরির সময় সকল অংশীজনদের বিশেষ করে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর মালিকদের মতামত গ্রহণ করবে। সাংবাদিকরা কখনোই আমলাদের দ্বারা নীতিমালা তৈরির পক্ষপাতী ছিলেন না।”

আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এমনিতেই বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের ওপর এই নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ আরো প্রকট করবে।

“সরকারের আইন, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিকপক্ষ সবদিক দিয়েই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। নতুন এই নীতিমালা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ। এতে সৃজনশীল চিন্তাশক্তির ওপর আক্রমণ হবে।”

‘অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্স’র সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালক শাইখ সিরাজ বলেন, “আমরা একটি নীতিমালা চেয়েছিলাম। এই চাওয়ার পেছনে কয়েকটি যুক্তিও ছিল। যেমন চাইলেই যে কেউ যেন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স না পায়।

“বর্তমানে যে নীতিমালা করা হয়েছে, এরকম নীতিমালা আমরা চাইনি। এই নীতিমালায় আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে বলা হয়েছে।”

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি ও বৈশাখী টিভির প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলেও এর সীমাবদ্ধতার কথাও বলেন।

“তবে অনেকেই না বুঝে এই নীতিমালা নিয়ে সমালোচনা করছেন। এর ইতিবাচক দিকও রয়েছে। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। দেশে উজ্জ্বল সাংবাদিকতা যেমন অগ্রসর হচ্ছে, তেমনি অপসাংবাদিকতাও থেমে নেই। অপসাংবাদিকতা দূর করতেই নীতিমালা প্রয়োজন।”

এরপরই তিনি বলেন, তারা সাংবাদিকদের জন্য চারটি বিষয়ে সুরক্ষা চেয়েছিলাম। এগুলো হল- সাংবাদিকতা পেশায় নতুনদের চাকরির নিরাপত্তা, টিভি চ্যানেলগুলোর বেতন বৈষম্য দূর করা, বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা ও লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম। এ বিষয়গুলো এই নীতিমালায় নেই।

বুলবুলের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের আরেক অংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, “কাদের নিরাপত্তার জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছে, তা জনগণ অনেক আগেই বুঝেছে।

“গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এই নীতিমালা করা হয়েছে। এই নীতিমালা গণমাধ্যমের জন্য এক অশনি সংকেত।”

অনুষ্ঠানে উপস্থিত নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরকার সম্পূর্ণ আস্থাশীল। নীতিমালা প্রণয়নের অর্থ গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা নয়।

“গণমাধ্যমকে আরো বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্যই এই নীতিমালা করা হয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার যেন কেউ না করে সেই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিও এই নীতিমালার অন্যতম উদ্দেশ্য।”

তবে তার সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে ব্যারিস্টার আমীর বলেন, “সরকার একদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছে। অন্যদিকে নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমকে কঠোর জবাবদিহিতার মধ্যে এনেছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করবে।

“যারা এ নীতিমালা করেছে তারা সত্যিই সরকারের বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী কি না, তা সরকারকে এখনই খতিয়ে দেখতে হবে।”

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরের সিইও মোজাম্মেল বাবু, মাছরাঙা টিভির সিইও ফাহিম মুনয়েম, এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা, এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ ই মামুন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, দৈনিক নিউ এইজ’র সম্পাদক নুরুল কবির প্রমুখ।