সুমনের পরিবার গত আট মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে নিজের পরিবারের বর্তমান হাল তুলে ধরতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম।
“এ কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না,” সানজিদার কান্না ছুঁয়ে যায় অন্যদেরও, যাদের বেশির ভাগই একই ধরনের দুর্ভোগ চেপে এসেছিলেন এই জাতীয় সম্মেলনে,‘মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি’ নামে একটি সংগঠনের আয়োজনে।
‘স্বজনদের ব্যথা-গুম, খুন ও নির্যাতন আর না’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে রাজনীতিক কামাল হোসেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খালেকুজ্জামান এই সমস্যাকে জাতীয় সঙ্কট অভিহিত করে এ থেকে উত্তরণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ‘গুমের’ জন্য সরকারকে দায়ী করা হলেও মন্ত্রীরা তা অস্বীকার করে আসছেন।
অনুষ্ঠানে শাহদীন মালিক দাবি করেন, “গুমের ঘটনাগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হয় না। তবে ক্ষমতার মোহে যদি কেউ এটি করেই থাকেন তবে তাদের পরিণতি ভালো হয় না।”
‘গুমের’ ঘটনার বিচার না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবেন বলেও ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
সানজিদার ভাষ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে ‘র্যাব-১’ লেখা তিনটি গাড়িতে তার ভাইসহ কয়েকজনকে তুলে নেয়া হয়।
“একটা গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি করা কি পাপ? যদি তা না হয়, তাহলে কেন আমার ভাইকে গুম করা হল,” প্রশ্ন ছুড়ে দেন সানজিদা।
সানজিদার মতোই দিন কাটছে কুমিল্লার লাকসামের সাবেক বিএনপি সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের পরিবারের। গত বছরের নভেম্বর থেকে নিখোঁজ এই মুক্তিযোদ্ধা, যার জন্য র্যাবকেই দায়ী করছে পরিবার।
সাইফুলের মেয়ে মাশরুফা ইসলাম বলেন, “বাবার মুক্তির জন্য র্যাবকে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। তোদের টাকা লাগলে আরো চাইতি, আমরা দিয়ে দিতাম। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেন নিয়ে গেলি?”
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে অশ্রুসজল চোখে তিনি বলেন, “আপনিও আপনার পরিবার হারিয়েছেন। যারা স্বজনদের পাচ্ছেন না, র্যাব পুলিশ যাদের গুম করেছে, আপনি তাদেরকে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিন।
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে তো আপনি নিজেই আছেন, আমাদের বাবা, ভাইদের ঘরে ফিরিয়ে দিন।”
ঢাকায় বিএনপি সমর্থিত সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার মুক্তা বলেন,“তাকে এত বছরেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন, তা আমরা জানতে চাই।
“বাবা নাই এই কথাটা ভাবতেও ভীষণ কষ্ট লাগে। যার পরিবারের কেউ গুম হয়েছেন, তারাই এ কষ্টটা বুঝতে পারবে।”
২০১২ সালে সাভারের নবীনগর থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিঁখোজ’ শিক্ষার্থী আল মুকাদ্দেসের বাবা আবদুল হালিমও এসেছিলেন অনুষ্ঠানে।
“প্রতিরাতে ভাবি, ছেলেটার মুখ আর কখনোই কি দেখতে পারব না? কী এমন দোষ করেছিল ছেলেটা যে তাকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিতে হবে।”
“আমি দুই হাত তুলে আল্লারে বলি, মওলা আমার কলিজার টুকরাটাকে ফিরিয়ে দাও,” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
গত ২৯ এপ্রিল র্যাব পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নেয়ার পর ৩০ এপ্রিল নবীনগর থানায় শাহনুরের বিরুদ্ধে র্যাব চাঁদাবাজির মামলা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে ৪ মে তাকে কুমিল্লার হাসপাতালে নেয়া হয়, ৬ মে মারা যান তিনি।
মেহেদী বলেন, “ভাইয়া কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।এলাকায় রড সিমেন্টের ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। হঠাৎ একদির র্যাব পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়।”
“ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় র্যাব-১৪ এর ভৈরব ক্যাম্পের অধিনায়কসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার ধরনা দেয়ার পরও কোনো সুফল পাইনি। উল্টো আমার ভাইকে তুলে নিতে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই ক্যাপ্টেন শাকিব সিদ্দিক বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।”
অনুষ্ঠানে সারাদেশে ‘গুম’ ও ‘নিখোঁজ’ হওয়া শতাধিক মানুষের স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন, বক্তব্য রাখার সুযোগ পান ২৪ জন।
অনুষ্ঠানে সবার কথা শুনে গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, “আগে গুম হয়েছে বলতে গিয়ে অনেকে সংকোচ করত এই ভেবে যে তাকেও গুম হওয়া লাগতে পারে। তবে মানুষের মনে এখন আর সে ভয় নেই।
সিপিবি সভাপতি সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ছাড়াও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, নিজরা করির খুশি কবির, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে সঞ্চালক শাহদীন মালিক বলেন, বিভিন্ন জেলা শহরে গিয়ে গুম-নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যরা কথা তুলে ধরার পরিকল্পনা করছেন তারা।