অপেক্ষায় আলোচিত ৬ মামলা

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ের করা আলোচিত ছয়টি মামলা ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ে ‘আটকে’ আছে।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2014, 04:26 AM
Updated : 30 August 2014, 11:32 AM

এর মধ্যে রায়ের অপেক্ষায় আছে দুটি, যার একটি আপিল বিভাগে এবং অন্যটি ট্রাইব্যুনালে রয়েছে। এছাড়া আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে আরও চার মামলা।

সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মামলা শুনানির ক্রম নির্ধারণের এখতিয়ার কেবল প্রধান বিচারপতির। প্রয়োজন অনুসারে তিনিই নির্ধারণ করবেন কোন মামলার পর কোন মামলা আসবে।

আপিল বিভাগে রায়ের অপেক্ষায় থাকা মামলাটি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আপিলের শুনানি শেষে প্রায় চার মাস আগে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়।

এরপর থেকে মামলাটি ওই পর্যায়েই রয়েছে, এর আগে এই পর্যায়ে কাদের মোল্লার মামলার সময় লেগেছিল দুই মাসেরও কম।

ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে সাঈদীর বিচার শুরু হয় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর, রায় হয় ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি।

অন্যদিকে দ্বিতীয় অভিযুক্ত কাদের মোল্লার বিচার তার পরে ২০১২ সালের ২৮ মে শুরু হলেও রায় আগেই হয়। সাঈদীর মামলার রায়ের ২৩ দিন আগে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার রায় হয়।

ট্রাইব্যুনালে এই দুই মামলার আগে প্রথম মামলা হিসাবে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের রায় ঘোষণা করা হয়। তবে তিনি পলাতক থাকায় মামলাটি আপিল বিভাগে আসেনি।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালে রায় হওয়া কাদের মোল্লার আপিল শুনানি শুরু হয় দুই মাসেরও কম সময়ে একই বছরের ১ এপ্রিল। অন্যদিকে একই মাসে রায় হলেও ৭ মাস পর গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাঈদীর আপিল শুনানি শুরু হয়।

আপিল বিভাগে চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমান করার দুই মাসেরও কম সময়ে কাদের মোল্লার সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হলেও একই পর্যায়ে চার মাস হয়ে গেছে সাঈদীর মামলা। গত ১৬ এপ্রিল এই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান করা হয়।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়ার দুটি অভিযোগে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়।

আরো ছয়টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে আদালতে প্রমাণিত হলেও এর মধ্যেই ফাঁসির আদেশ হওয়ায় সেগুলোতে কোনো দণ্ড দেয়নি আদালত।

এই রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৮ মার্চ আপিল করেন সাঈদী। অন্যদিকে প্রমাণিত হলেও সাজা না হওয়া ছয় অভিযোগে এই জামায়াত নেতার শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

‘শুনানির অপেক্ষায় চার মামলা’

এদিকে প্রক্রিয়াগত সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও চার মামলা।

মামলাগুলো হচ্ছে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজহিদ, জামায়াতের সাবেক আমির ও ‘রাজাকারগুরু’ নামে পরিচিত গোলাম আযম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জিয়া সরকারের মন্ত্রী আব্দুল আলীমের।

আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় থাকা মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের মামলা, যাকে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

রায়ের একমাসের মধ্যে ১১ অগাস্ট আপিল করেন মুজাহিদ। এই মামলায় কেবল মুজাহিদই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আপিল নেই।

মুজাহিদের পরেই রয়েছে, জামায়াতগুরু গোলাম আযমের মামলা, অপরাধ বিবেচনায় ‘সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য’ হলেও ‘বয়স ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায়’ ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

ওই বছরের ৫ অগাস্ট বেকসুর খালাস চেয়ে দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম। তবে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের হোতা গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে গত ১২ অগাস্ট আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

আপিল বিভাগের মামলাক্রমে এরপরই রয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা। গত বছরের ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তার ফাঁসির রায় দেয়।

সকল অভিযোগ থেকে খালাস চেয়ে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২৯ অক্টোবর আপিল করেন সাকা। এই মামলায়ও রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আপিল নেই।

ট্রাইব্যুনালের দণ্ডের পর আপিল বিভাগে আসা মামলাগুলোর মধ্যে সর্বশেষে রয়েছে আব্দুল আলিমের মামলা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৯ অক্টোবর রায় ঘোষণার পর ৭ নভেম্বর খালাস চেয়ে আপিল করেন আলিম। মৃত্যুদণ্ড না হলেও এই মামলায় সর্বোচ্চ সাজার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনো আপিল করা হয়নি।

পলাতক থাকায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের মামলা আপিল বিভাগে আসেনি।       

‘এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির’

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোন মামলার পর কোন মামলার শুনানি হবে- এ বিষয়টি বিবেচনার এখতিয়ার একমাত্র প্রধান বিচারপতির।

“নিজ প্রজ্ঞা দ্বারা প্রয়োজন ও অবস্থা বিবেচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে আইনজীবীরা চাইলে তাদের মামলা শুনানির জন্য মেনশন (পেশ) করতে পারেন। আদালত চাইলে আর্জি মঞ্জুর করে শুনানির ব্যবস্থা করতে পারেন।”

“শুনানিতে কতদিনের পুরাতন মামলা, জরুরি বিবেচনা করা হয়।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের মামলা কিছুটা ভিন্ন। অন্য মামলার তুলনায় দ্রুততার সঙ্গেই এই মামলাগুলো শুনানি করা হচ্ছে। একটার পর একটা শুনানি হচ্ছে।

আইনে ৬০দিনের সময়সীমা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এই সময়সীমা নির্দেশনামূলক। বাধ্যতামূলক নয়। তবে এরপরও কোনো পক্ষ চাইলে মেনশন করতে পারেন। আদালত পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা মঞ্জুরও করতে পারেন।

‘বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে নিজামীর রায়’

অন্যদিকে তিনবার পিছিয়ে ৯ মাস ধরে ট্রাইব্যুনালে রায়ের জন্য অপেক্ষমান একাত্তরে দলগতভাবে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী সংগঠন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলা।

একই দলের অপর নেতা কাদের মোল্লার সঙ্গে ২০১২ সালের মে মাসে তার বিচার শুরু হয়েছিলো। কাদের মোল্লার মামলা আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়ে রায় কার্যকর হয়ে গেলেও ট্রাইব্যুনালেল চৌহদ্দি পার হতে পারেনি নিজামীর মামলা।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগ শুনানির পর ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর নিজামীর মামলাটি রায়ের রাখা হয়।

সে সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। তবে রায় হওয়ার আগেই তিনি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেলে এই আদালতের বিচার কার্যক্রমে কার্যত স্থবিরতা তৈরি হয়। ঝুলে যায় নিজামীর রায়ও।

পরে এবছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে ওই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।

দায়িত্ব নিয়ে আসামিপক্ষের আবেদনে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এই মামলার যুক্তিতর্ক আবার করতে আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর নতুন এই চেয়ারম্যান।

দ্বিতীয় দফা যুক্তিতর্ক শেষে গত ২৪ মার্চ নিজামীর যুদ্ধাপরাধের মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে ট্রাইব্যুনাল।

রায় লেখার পর গত ২৩ জুন আদালত জানায়, পরদিন রায় ঘোষণা হবে। ওইদিন নিজামী অসুস্থ্য হয়ে যাওয়ায় রায় ঘোষণা স্থগিত করা হয়।

এই মামলাটির আইনগত অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান আছে। এখন এটি একান্তই ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। উপযুক্ত সময় হলে আদালত নিশ্চয়ই একটি ভালো রায় দেবে।”