বন্যার বিস্তার বাড়ছে

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের অধিকাংশ প্রধান নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যা দুর্গত ১৭ জেলার মধ্যে নয় জেলার পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে, প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2014, 09:37 PM
Updated : 29 August 2014, 09:39 PM

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী ৭২ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা এবং রাজধানী ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোর পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

এই সময়ে রাজধানীর আশেপাশে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও  টঙ্গী খালের পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি মিরপুর পয়েন্টে তুরাগের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

আগামী তিন দিনে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী এবং  ফরিদপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র। পাশাপাশি বগুড়া,  সিরাজগঞ্জ,  জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার অবস্থা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

তবে গঙ্গা অববাহিকার নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় আগামী ৭২ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, রংপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হতে পারে বলে আশা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

শুক্রবার দেশের ১৫টি নদীর পানি ২০টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরমধ্যে ১৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।

ভাটির নদ-নদীগুলোর পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় ইতোমধ্যে এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর হারিয়েছেন; পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। 

শুক্রবার এসব জেলার শতাধিক ইউনিয়ন নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে। রোপা, আমন ও সবজি ক্ষেতসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো।

বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে সরকারি ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা হলেও পরিমাণে তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকালে কুড়িগ্রামে ধরলার পানি বিপদ সীমার ৩৪ সেন্টিমিটার, গাইবান্ধায় ঘাগট নদী ৬৪ সেন্টিমিটার, চিলমারিতে ব্রক্ষপুত্রের পানি ৪৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 

যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদ সীমার ৭০ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে ৯৭ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ৪১ সেন্টিমিটার ও আরিচায় ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল।

বাঘাবাড়িতে আত্রাই নদী বিপদ সীমার ৩ সেন্টিমিটার, সিংড়ায় গুর নদী ৯৪ সেন্টিমিটার, এলাশীনে ধলেশ্বরী ৮০ সেন্টিমিটার, তারাঘাটে কালিগঙ্গা ৭ সেন্টিমিটার এবং লক্ষ্যা নদী লাখপুরে ৮২ সেন্টিমিটার ও নারাযণগঞ্জে ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।

গোয়ালন্দে পদ্মা নদী বইছে বিপদ সীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে; ভাগ্যকলে ১৭ ও সুরেশ্বরে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।

এছাড়া সুনামগঞ্জে সুরমা নদী বিপদ সীমার ১০ সেন্টিমিটার, শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদী ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, দিরাইয়ে পুরাতন সুরমা নদী ২৭ সেন্টিমিটার এবং জারিয়াজাঞ্জাইলে কংশ নদী ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।

বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

মুন্সীগঞ্জ

মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি পদ্মার তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে নদী ভাঙন।

লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কামারখাড়ায় পদ্মার ভাঙন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ভাঙনের মুখে কামারখাড়া বড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল জানান, ৪৯টি পরিবারের বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ৮২৩টি পরিবারের বাড়িঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নতুন প্লাবিত এলাকাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা এখনো তৈরি হয়নি বলে জানান তিনি ।

এদিকে শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকূল ও বাঘরা, লৌহজংয়ের মেদিনীমণ্ডল, হলদিয়া, কনকসার, কুমারভোগ সিরাজদিখানের চিত্রকোট, টঙ্গীবাড়ির পাঁচগাঁও, হাসাইলবানারী, সদর উপজেলার শিলইসহ বিস্তীর্ণ এলাকার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

জেলা প্রশাসক জানান, বন্যার পর যাতে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে না পরে, সেজন্য দুর্গত গ্রামগুলোতে মেডিকেল টিম কাজ করছে।

বন্যার্তদের জন্য জেলায় সরকারিভাবে একশ’ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে জেলা প্রশাসন থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ

যমুনার পানি বাড়তে থাকায় সিরাজগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল চন্দ্র শীল জানান, যমুনার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির উচ্চতাও বেড়ে গেছে। প্রবল স্রোতের কারণে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।

এদিকে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে পানির প্রবল তোড়ে কাজিপুর উপজেলার মেঘাই এলাকায় অবস্থিত রিং বাঁধ ধসে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

কাজিপুরের ইউএনও শাফিউল ইসলাম বলেন, এ ধসের কারণে নতুন করে অন্তত ছয়শ' পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এছাড়া কাজিপুর থানার কাছে সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর আঞ্চলিক সড়কের উপরে পানি ওঠেছে। সড়ক বিভাগ সেখানে বালির বস্তা ফেলে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

জেলার চরাঞ্চলে প্রায় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি এক থেকে তিন ফুট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে বাড়ছে ডাইরিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা।

জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন বলেন, “নতুন করে পানি বাড়ায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়াসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ত্রাণ বিতরণ করছেন।”

আরো ত্রাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বগুড়া

যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ায় বগুড়ায় সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

সারিয়াকান্দিতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাঁধ ভেঙে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে রয়াদহ, শেখেরপাড়া, কড়িতলা, কুতুবপুর, দড়িপাড়াসহ ধুনট উপজেলা জোড়শিমুল, শিখাহাটি, সোনাগা, গজারিয়াসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়।

বন্যার পানিতে ধুনট উপজেলায়তেও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে কয়েকশ’ হেক্টর ফসলি জমি।

সারিয়াকান্দির স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান,  ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গৌতম কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহম্মেদ, বগুড়ার জেলা  প্রশাসক শফিকুর রেজা বিশ্বাস, পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক শুক্রবার ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেন।

বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানও ধুনটের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

গাইবান্ধা

গাইবান্ধায় ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশিলী আব্দুল আউয়াল জানিয়েছেন, ঘাঘট নদীর পানির চাপে শহরের পূর্ব কোমরনই মিয়া পাড়ায় ওয়াপদা বাঁধে শুক্রবার ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে বাঁধের উপর দিয়ে গাইবান্ধা-গিদারী রুটে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

লছড়ি উপজেলার উদাখালি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল বাকী সরকার জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি স্থান দিয়ে পানি চুইয়ে অপর পারে পড়তে শুরু করেছে। ফলে এলাকার মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অফিসের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল হুদা জানান, প্রতিদিনই ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।

সরকারি হিসাবে শুক্রবার পর্যন্ত জেলার ১৭ হাজার ৭৪টি পরিবারের ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চার টি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের ২৫ হাজার ৮০২টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

কুড়িগ্রাম

বন্যার কারণে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে রয়েছে। শুক্রবারও নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় শুক্রবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক জরুরি সভা হয়, যাতে স্বাস্থ্যবিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পশু সম্পদ বিভাগকে সর্বোচ্চ সর্তক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।

এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপাতত ছুটি না নিদে বলা হয়েছে।

সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পানি বাড়তে থাকায় শুক্রবারও নতুন নতুন চর-দ্বীপ প্লাবিত হয়েছে।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন জয়নাল আবেদিন জিল্লুর জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দুর্গত এলাকায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক প্রতীপ কুমার মণ্ডল জানান, জেলার নয় উপজেলায় প্রায় দুই লাখ কৃষকের ৩২ হাজার হেক্টর সবজি ও ফসলি জমি এখন বন্যার পানির নিচে।

জেলা ত্রাণ বিভাগের কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫৬টি ইউনিয়নের ৪১৬ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার পরিবার।

জেলার প্রায় ৮৯ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা, ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৩ কিলোমিটার বাঁধ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যার্তদের জন্য শুক্রবার পর্যন্ত আটশ’ মেট্রিকটন চাল ও ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে মিজানুর রহমান জানান।