একটির কূল-কিনারা নেই, ঘটল আরেকটি খুন

আট মাসেও রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশন রোডে কথিত পীরসহ ছয় খুনের ঘটনার কোনো কূল-কিনারা করতে না পারার মধ্যেই একই ধরনের আরেকটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নামতে হল পুলিশকে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল তালুকদার ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2014, 01:25 PM
Updated : 29 August 2014, 09:46 AM

বুধবার ইসলামী ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যার পর ছয় খুনের তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন,“দুটি হত্যাকাণ্ডের ধরন প্রায় একই রকম।”

দুই হত্যাকাণ্ডের পেছনে একই ব্যক্তিরা বলেও সন্দেহ গোয়েন্দা পুলিশের এই উপকমিশনারের, যদিও আট মাসের তদন্তেও আগের হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি তিনি।

গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বরে চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার বাসায় মুরিদ সেজে ঢুকে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, তার ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক ওরফে মনির, পীরের খাদেম মঞ্জুর আলম মঞ্জু, মুরিদ মো. শাহিন, রাসেল ও মুজিবুল সরকারকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

বুধবার রাত ৮টার দিকে ১৭৪ পূর্ব রাজাবাজারের একটি চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় হজে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনার কথা বলে ঢুকে মাওলানা ফারুকীকে (৫০) গলা কেটে হত্যা করা হয়।

দুটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম, তবে কথিত পীরের ক্ষেত্রে তার সঙ্গীদেরও হত্যা করা হয়েছিল। ফারুকীর বাড়িতে যারা ছিলেন, যাদের হাত-পা বেঁধে রাখলেও অন্য কিছু করা হয়নি।

নিজেকে পীর দাবি করায় লুৎফর রহমানের ওপর উগ্র ইসলামপন্থিরা ক্ষিপ্ত ছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

একইভাবে সুন্নিবাদী সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতা ফারুকী হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও হিযবুত তাওহিদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকেও হুমকি দেয়া হচ্ছিল বলে তার অনুসারীরা জানিয়েছেন।

লুৎফরসহ ছয়জনকে হত্যার সময় তার বাড়িতে ১০-১২ জন ঢুকেছিল এবং হত্যা করেই চলে যায়, বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র খোয়া গেলেও তাতে ঘটনাটি ডাকাতি বলে মনে হয়নি পুলিশের কাছে।

তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর মাতুব্বরের ধারণা, ধর্মীয় উগ্রপন্থী দলগুলোর কোনো একটি ছয় খুনের ঘটনায় জড়িত এবং সম্ভবত তা নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি।

খুনিদের চিহ্নিত করতে না পারলেও এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশ প্রতিদিনই ওই মামলা নিয়ে কাজ করছে। তবে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়ার মতো কিছু এখনো পাওয়া যায়নি।”

গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুয়াল খায়ের মাতুব্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই হত্যার ঘটনায় তারা এ পর্যন্ত ৩৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাননি।

কথিত পীর লুৎফরের ছবি নিয়ে স্বজনদের আহাজারি (ফাইল ছবি)

লুৎফরের ছোট ছেলে ও মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল ফারুক হতাশা প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রথম দিকে তদন্তের গতি থাকলেও ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ে।

তার সন্দেহের কথা জানতে চাইলে নিহতের এই ছেলে বলেন, “আমার মনে হয়, কোনো জঙ্গি সংগঠনই বাবা-ভাইসহ অন্যদের হত্যা করা হয়েছে।

“বাবার গ্রামের বাড়িতে বা ব্যাংকে এমন কোনো টাকা-পয়সা নেই, যার কারণে তাকে খুন করা হবে। বাবার লেখালেখি এবং মতবাদের জন্যই এই ঘটনা।”

বুধবার নিহত ফারুকী ছিলেন ইসলামী ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যে সংগঠনটি জামায়াত-হেফাজতবিরোধী। পাশাপাশি তিনি চ্যানেল আইয়ে ‘কাফেলা’ ও ‘শান্তির পথে’ শিরোনামে দুটি অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করতেন।

ইসলামী ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত ফজলুল হক তার সন্দেহের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (ফারুকী) ইসলামের মূল বাণী প্রচার করতেন। হিযবুত তাওহীদ, জামায়াত-শিবির, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। এজন্য অনেকে তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।

নুরুল ইসলামের সার্বক্ষণিক সহচর আহমদ নুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলায় উনাকে এর আগেও হুমকি দেয়া হয়েছিল।”

এই বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন ঘটনাস্থলে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধর্মীয় মতভেদের বিষয়টিকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কেননা এর আগে তাকে হুমকিও দেয়া হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।”

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একই কথা বলেন।

“বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে এনে কাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ধর্মীয় মতভেদের বিষয়টি প্রথমে রয়েছে।”

ফারুকীর স্বজনরা জানিয়েছেন, বাসায় হানা দেয়া যুবকদের মধ্যে একজনের মাথায় টুপি এবং ছোট ছোট দাড়ি ছিল। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

ফারুকীর ‘ফারুকী ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি হজযাত্রী পাঠাতেন।

হজে যাওয়ার আলোচনার কথা বলেই প্রথমে দুই যুবক তার বাড়িতে ঢুকেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, পরে আরো ৬-৭ যুবক ঢুকে পড়ে।

হজে মানুষ পাঠানো নিয়ে কোনো জটিলতা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে কি না, তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব জানান।

ফারুকীর দুজন স্ত্রী। ছোট স্ত্রী লুবনা ইসলাম তার তিন ছেলে নিয়ে ফারুকীর সঙ্গে থাকলেও অন্য স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে রাজধানীর মালিবাগে থাকেন।

একাধিক স্ত্রী থাকায় পারিবারিক কোনো বিরোধ ছিল কি না, তা-ও তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।  

নুরুল ইসলাম ফারুকী

পরিবারের পক্ষ থেকে যে মামলা করা হয়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায়, তাতে ডাকাতির কথাও বলা হয়েছে। 

এতে বলা হয়, নগদ ২ লাখ টাকা, একটি ক্যামেরা, একটি ট্যাব এবং প্রায় সাড়ে ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় ৬ লাখ টাকার মালামাল লুট হয়েছে।

মামলাটি করেছেন নিহতের মেজ ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল ফারুকী। তার বড় ছেলে আহমেদ রেজা ফারুকী সৌদি আরবে রয়েছেন।

ঘটনার সময় বাসায় ছিলেন ফারুকীর স্ত্রী লুবনা (৪০), লুবনার বৃদ্ধা মা জয়গুন নেছা (৭০), গৃহকর্মী শরিফা খাতুন (৩৫), ফারুকীর ভক্ত দুই নারী, যাদের সবাইকে বেঁধে রাখা হয়েছিল।

ফারুকীর ভাগ্নে মারুফকে উদ্ধৃত করে রাজধানীর মিরপুরের বায়তুল রশিদ মসজিদের ইমাম মুফতি ইহসানুল হক হত্যাকাণ্ডের পর সাংবাদিকদের বলেন, “সাড়ে ৮টার দিকে হজে যাওয়ার কথা বলে দুই যুবক বাসায় আসে। দরজা খোলার পর তাদের সঙ্গে আরো ৬/৭ জন লোক ঢুকে পড়ে।

“তারা অস্ত্র বের করে বলে- কত টাকা আছে, আমাদের দেন। নুরুল ইসলাম বলেন, এখন বাসায় এক লাখের মতো টাকা আছে। তখন তারা বলে- আমরা এতগুলো মানুষ, এক লাখ টাকায় আমাদের হবে না।”

এরপর বাড়ির সবাইকে গামছা ও কাপড় দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফারুকীকে শোবার ঘরে নিয়ে জবাই করে যুবকরা চলে যায় বলে মুফতি ইহসানুল জানান।

ওই যুবকরা আসার আগে এক মহিলা ভক্ত পরিচয় দিয়ে বাড়িতে ঘুরে গিয়েছিল বলে ফারুকীর স্বজনরা জানিয়েছেন।

মামলায় ডাকাতির পর হত্যার কথা বলা হলেও ঘটনাটি নিছক ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যা বলে মনে করছে না পুলিশ ও র‌্যাব।

র‌্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান আশা করছেন, যে কারণই থাক না কেন, অচিরেই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।