৪ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, জামালাপুর ও গাইবান্ধার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2014, 12:46 PM
Updated : 28 August 2014, 01:00 PM

এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর হারিয়েছেন; পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।  এসব জেলার শতাধিক ইউনিয়ন নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে। রোপা, আমন ও সবজি ক্ষেতসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে অপর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতার কারণে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন:

জামালপুর:

পাহাড়ী ঢলে ও যমুনার পানি বেড়ে জামালপুরে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ৩৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ব্র‏হ্মপুত্র ও জিঞ্জিরামসহ শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেলেও বিপদ সীমার নীচে রয়েছে।

এছাড়া ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ ও সদর উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার অন্তত দু্ই লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

ইসলামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নবী নেওয়াজ খান লোহানী বিপুল জানান, ইসলামপুরের ১২টি ইউনিয়নই এখন বন্যাকবলিত। উপজেলার অন্তত ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রোপা, আমন ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা আরো জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

মাদারগঞ্জের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান বেলাল জানান, মাদারগঞ্জের অন্তত ৫০/৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।

তিনিও বন্যা দুর্গতদের মাঝে সরকারি ত্রাণ তৎপরতা বৃদ্ধির দাবি জানান।

মেলান্দহ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একে এম হাবিবুর রহমান চাঁন জানান, মেলান্দহ উপজেলার ২৫/৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। 

পানির তীব্র স্রোতে মেলান্দহ-মাহমুদ সড়কের কজওয়ে (ড্রাইভাশন) ডুবে ভেঙ্গে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

এই উপজেলায় এখনো কোন ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি বলে জানান তিনি।

জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, সরকারিভাবে জেলায় বন্যা দুর্গতদের জন্য এ পর্যন্ত ৬০ টন চাল ও নয় লাখ টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

জেলার ৯১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সংস্কার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম জানান, বন্যায় জেলার ২০ হাজার ৪৪৬ হেক্টর জমির রোপা, আমন, আউশ ও সবজির ক্ষেত ডুবে গেছে।

সিরাজগঞ্জ:

যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ সেন্টিমিটার বেড়ে জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

বন্যায় জেলার সাতটি উপজেলার ৪৬ ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল চন্দ্র শীল জানান, টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে পানি আরো বাড়তে পারে। যমুনার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীন নদ-নদীর পানিও বাড়তে শুরু করেছে। যেসব এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছিল তা আবারো প্লাবিত হয়েছে। 

এদিকে চরাঞ্চলসহ বন্যা কবলিত এলাকার উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল এখন পানির নিচে।

কৃষকরা জানায়, নতুন করে পানি আসায় জমিতে লাগানো ফসল আর ফিরে পাওয়ার আশা নেই। পানি নামার পর আবারো নতুন করে ফসল বুনতে হবে।

ত্রাণ বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগন্য বলে অভিযোগ করেছেন বানভাসি মানুষ। সেইসঙ্গে বিশুদ্ধ পানির অভাবে তারা দুঃসহ জীবন যাপন করছেন বলে জানিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন জানান, এ পর্যন্ত জেলার বন্যা কবলিতদের জন্য সরকারিভাবে ২৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চার লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১৫০ মেট্রিক টন চাল বিতরণের জন্য মজুদ রয়েছে।

আরো ত্রাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

গাইবান্ধা:

গাইবান্ধায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি ঘটেছে। প্লাবিত হয়েছে কৃষি জমিসহ নতুন নতুন এলাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ঘাঘট নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁইছু্ইঁ করছে।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মীর আব্দুর রাজ্জাক জানান, গত দুদিনের পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার চারটি উপজেলা ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদরে নুতন করে এক হাজার ১৫৮ হেক্টর আবাদী জমি তলিয়ে গেছে। ফলে বর্তমানে নিমজ্জিত আবাদি জমির পরিমাণ তিন হাজার ৭৯ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে।

সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মন্ডল, ঘুড়িদহ ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান এবং সাঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন সুইট জানান, গত দুদিনে হলদিয়া চিনিরপটল পালপাড়ার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে চিনিরপটল, চকপাড়া, পবনতাইড়, থৈকরপাড়া, গোবিন্দি, বাঁশহাটা, সাথালিয়া, হলদিয়াসহ ১০টি গ্রাম নতুন করে বন্যা কবলিত হয়েছে।

ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল বাকী সরকার বলেন, ব্রহ্মপুত্রের পানির তীব্র স্রোতের কারণে উপজেলার সিংড়িয়া এলাকায় নদী ভাঙনের ব্যাপকতা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৫টি পরিবারের বাড়ি-ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন কবলিত নদী থেকে ১৫ ফুট দুরে থাকায় সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ  হুমকির মুখে পড়েছে।

গাইবান্ধা সদরে ঘাঘট নদীর পানির চাপে শহর রক্ষা বাঁধের দশানি এলাকায় একশ’ ফুট রয়েছে হুমকিতে। বাঁশের পাইলিং ও বালুর বস্তা ফেলে মেরামতের চেষ্টা চললেও এলাকাবাসীর মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।

তবে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষায় দিন রাত কাজ চলছে।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অফিসের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল হুদা জানান, গত তিনদিনে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ির সংখ্যা তিন হাজার ৬১০টি বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৫৪টি। এরমধ্যে সস্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাত হাজার ২৩৩ এবং আংশিক আট হাজার ৮২১টি।

এ পর্যন্ত জেলার চার উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের ২৪ হাজার ৯৪টি পরিবারের এক লাখ ১৬ হাজার ৫০৩ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কুতুবউদ্দিন জানান, পানি উঠে পড়ায় জেলার ১৭৮ টি সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

কুড়িগ্রাম:

কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলা, ব্রহ্মপুত্র তিস্তা, দুধকুমারসহ জেলা ১৬টি নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৪০ সে.মি ও ধরলা নদীর পানি ৪৩ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া দুধকুমার নদীর পানি ১০ সে.মি বৃদ্ধি পেয়েছে।

কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ বিভাগের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো তিন ইউনিয়নসহ মোট ৫৬টি ইউনিয়নের ৩৫৩টি গ্রাম পানিবন্দি হয়েছে। এতে ৪১৬ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩ হাজার ৫২ পরিবার।

এছাড়াও ৮৮ কি.মি কাঁচা রাস্তা ও ১ কি.মি পাকা রাস্তা  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৩ কি.মি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য এখন পর্যন্ত আটশ টন চাল ও ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক প্রতীপ কুমার মণ্ডল জানান, জেলার নয় উপজেলায় এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ২৩৬ হেক্টর সবজী ও ফসলী জমি এখন বন্যার পানির নীচে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।

কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে পাইকের ভিটা, দোয়ানপাড়া, হিন্দু পাড়া, সুখু পাড়া, সেন পাড়া, মন্ডল পাড়া, মরা গ্রাম, গারু হারা, উত্তর ঘন শ্যামপুর ও উত্তর ছত্রপুর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও পানি নিচে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাটি ও বালির বস্তা ফেলে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।