‘৪০ হাজার টাকায় ধাত্রীর মাধ্যমে চুরি হয় শিশুটি’

এক সপ্তাহ আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া শিশুটিকে গাজীপুর থেকে উদ্ধার করে বাবা-মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে র‌্যাব।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2014, 03:27 AM
Updated : 29 August 2014, 11:35 AM

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রাশেদা খানম পারভীন (৪৮) নামের এক ধাত্রী গত ২১ অগাস্ট হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে চুরি করে। তারপর ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে শিশুটিকে তিনি তুলে দেন বেলি আক্তার ওরফে রহিমা নামে ৪৫ বছর বয়সী নিঃসন্তান এক নারীর হাতে।

বুধবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে গাজীপুর বোর্ডবাজারের উত্তর কলমেশ্বর এলাকার বটতলা রোডে রহিমার বাসা থেকেই শিশুটিকে উদ্ধার করেন র‌্যাব সদস্যরা। গ্রেপ্তার করা হয় দুই নারীকে।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রুনা আক্তার গত ২০ অগাস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যমজ সন্তানের জন্ম দেন। পরদিন ভোরের দিকে তার একটি ছেলেকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান পারভীন, যিনি আরেক রুগীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ওই পরিবারের বিশ্বাস অর্জন করেন।

রুনার মা গুলেনুর বেগম সে সময় পুলিশকে বলেছিলেন, যমজ শিশু দুটিকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসার পর থেকেই এক নারীকে ওয়ার্ডে ঘুর ঘুর করতে দেখেন তারা। তাদের প্রশ্নের জবাবে ওই নারী বলেন, তার ভাবী পাশের ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।

পরদিন সকালে নবজাতক শিশু দুটো কান্নাকাটি শুরু করলে ওই নারী একজনকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন বলে জানান গুলেনুর বেগম। কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে নিয়ে উধাও হয়ে যান সেই নারী।

এ ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। শাহবাগ থানায় একটি মামলাও দায়ের করা হয়।

গণমাধ্যমে আসা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু চুরির সময় হাসপাতালের ৫৩টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার একটিও চালু ছিল না। ২০ অগাস্ট রাত ৯টা থেকে প্রায় ১২ ঘণ্টা হাসপাতালের সার্ভার স্টেশন বন্ধ ছিল। এরই মধ্যে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শিশুটি চুরি হয়।

বিষয়টি আমলে নিয়ে শিশু চুরির ঘটনায় বুধবার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

শিশুটিকে উদ্ধারের পর বৃহস্পতিবার দুপুরের আগে উত্তরায় র‌্যাব সদরদপ্তরে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানেই শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয়া হয় বাবা-মায়ের কাছে।

গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার দুই নারীকে এ সময় সাংবাদিকদের সামনে আনা হলেও তাদের কথা বলতে দেয়া হয়নি। 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাশেদা খানম পারভীন ধাত্রী বিদ্যায় প্রশিক্ষিত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বোর্ডবাজার এলাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে ধাত্রী হিসাবে কাজ করে আসছেন। সেখানে তার একটি ফার্মেসিও আছে।

“আমরা জানতে পেরেছি, বিভিন্ন সময়ে অনেকের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি শিশু চুরি করে আসছিলেন। তিনি জন্মের পর মা-বাবাকে বলতেন, শিশুটি মারা গেছে। পরে তিনি শিশুটি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতেন।”

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব বলছে, দীর্ঘদিন ধরে বাচ্চা না হওয়ায় বেলি আক্তার রহিমা মাস আটেক আগে পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের মধ্যে যে চুক্তি হয় তার ভিত্তিতেই ২১ অগাস্ট ঢাকা মেডিকেল থেকে শিশুটিকে চুরি করেন পারভীন।

মুফতি মাহমুদ বলেন, “২০ অগাস্ট রুনা আক্তার যমজ শিশুর জন্ম দেয়ার পর থেকেই ওই পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে শিশুদের খোঁজ খবর নিয়ে, কোলে নিয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে পারভীন তাদের আস্থা অর্জন করেন।

“২১ তারিখ সকালে মা যখন এক সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন সুযোগ পেয়ে পারভীন অন্য সন্তানকে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালের গেইট পার হয়ে যান।”

চুরির আগের দিন শিশু কোলে সেই ধাত্রী। সময় টিভিতে প্রচারিত সিসিটিভির ভিডিও থেকে নেয়া ছবি

সময় টিভিতে প্রচারিত সিসিটিভির ভিডিও থেকে নেয়া ছবি

এই চক্রের সঙ্গে আরো যারা জড়িত- তাদের ধরতে তদন্ত চলছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

মুফতি মাহমুদ বলেন, চুক্তি অনুযায়ী রহিমা শিশুটির জন্য পারভীনকে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। হাসপাতাল থেকে চুরি করার পর বোর্ড বাজারে রহিমার কাছে তুলে দেন পারভীন।  

“রহিমা তার স্বামীকে বলেছিলেন তার বাচ্চা হবে। ডেলিভারি হওয়ার কথা বলে তিনি আরেকটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। বাচ্চাটি হাতে পাওয়ার পর নিজের বাসায় ফিরে তিনি স্বামীকে বলেন, এটা তার নিজের বাচ্চা। যেহেতু সহজ সরল এবং গরিব লোক, সেহেতু তার স্বামী আর বুঝতে পারেননি যে এটা তার আসল বাচ্চা না।”

চুরি যাওয়া সন্তানকে ফিরে পেয়ে সংবাদ সম্মেলনে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেন মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার কাওসারহোসেন ও তার স্ত্রী রুনা আক্তার।

শিশুটিকে উদ্ধারের কৃতিত্ব সংবাদকর্মীদের দিয়ে তিনি বলেন, “আজ যদি মিডিয়া প্রচার না করত, আমার সন্তানকে উদ্ধার করা যেত না। সরকারকে ধন্যবাদ, প্রশাসনকেও ধন্যবাদ। মিডিয়ার প্রচারের কারণে তারা আমার সন্তানকে উদ্ধার করতে পারছে।

“তাই আমার চিন্তা ভাবনা, বড় হইলে আমার দোনোডা ছেলেকে সাংবাদিক বানাব।”

এ সময় উপস্থিত র‌্যাব সদস্য ও সাংবাদিকরা হাততালি দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন। পাশ থেকে একজন বলে ওঠেন, র‌্যাবই তো উদ্ধার করল।

জবাবে কাওসার বলেন, “আমি দুই ছেলেকেই সাংবাদিক বানাব চিন্তা ভাবনা করেছি। তবে আপানাদের অনুরোধ থাকলে একজন র‌্যাব, একজন সাংবাদিক। আপনারা দোয়া করবেন।”

রুনা আক্তার জানান, এক ছেলের নাম তারা রেখেছেন ইয়াসিন হোসেন, অন্যজনের এখলাস হোসেন।

এদিকে নবজাতক চুরির ঘটনায় বাবার-মায়ের অসচেতনতাকেই দায়ী করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।

দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “হাসপাতালে প্রতিদিন ত্রিশ থেকে চল্লিশটি শিশু ভূমিষ্ট হয়। মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয় শিশুটি কার কাছে দেয়া হবে। সে অনুয়ায়ী রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনের কাছে শিশুকে হস্তান্তর করা হয়।”

সেভাবেই চুরি হওয়া শিশুটি তার নানির কাছে দেয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি।

পরিচালক বলেন, “হাসপাতালের কোনো কর্মচারীর ওই ঘটনায় জড়িত থাকা সম্ভব নয়। তারপরও নবজাতক ওয়ার্ডের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।”