তরুণ এই প্রতিমন্ত্রী সোমবার কক্সবাজারে শিশু সাংবাদিক উৎসবে অনেকটাই মোহাবিষ্ট করে রাখেন দর্শক-শ্রোতাদের, প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে পেরে এবং তার উত্তর পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল শিশুরাও।
শিশুদের জন্য, শিশুদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘হ্যালো’র সাংবাদিক বাছাই উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়েই শিশুদের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেন পলক।
“তোমরা তো নিশ্চয়ই রাজনীতিবিদদের কথা শুনতে চাও না; কারণ, তারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করে না, তারা মিথ্যা কথা বলেন, পলিটিশিয়ান শুনলেই বিরক্ত হও, মনে হয় তোমরা মনে কর- তারা নোংরা কথা বলে... সেজন্য কথাও শুনতে চাও না।”
তখন উপস্থিতদের অনেকে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ বলে ওঠে।
এরপর প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য না রাখার ভঙ্গী করলে শিশু সাংবাদিকরা কথা শোনার জন্য তাকে চেপে ধরেন। তখন উল্টো শিশু সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুরু করেন প্রতিমন্ত্রী।
এত কম বয়সে দেশের এত বড় দায়িত্ব কেন নিতে চাচ্ছ- প্রতিমন্ত্রীর এই প্রশ্নে রিপন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, “দেশের নানা সমস্যা তুলে ধরে তা সমাধানের চেষ্টা করার জন্যেই সাংবাদিকতা।”
তখন পলক বলেন, “সবাই যদি তোমার মতো ভাবত, সব মন্ত্রী যদি তোমার মতো হত, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা যদি এমন হত, তবে দেশ তো ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে যেত।”
“তোমার কথা যাবে বহুদূর। একজন রিপনের কথা লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। কে জানে, প্রধানমন্ত্রী হয়ত তা দেখতে পাচ্ছেন। বিশ্বের কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তা তা দেখবে হয়ত, তোমাদের কোনো একজনের উৎসাহব্যঞ্জক কথা, উক্তি এ দেশে একটা প্রজেক্ট নিয়ে আসতে পারে,” বলে যান পলক।
অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী জানান, এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেটে ৬০ হাজার মানুষ সরাসরি দেখছে।
প্রযুক্তির এমন প্রসারের কথায় স্বপ্নভুক কিশোররা মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিয়ে সমর্থন জানাল প্রতিমন্ত্রীকে।
আর তিনি বললেন, “আমাকে সতর্ক হয়ে কথা বলতে হচ্ছে। শুধু মাত্র প্রতিশ্রুতি দেয়াটা শেষ কথা ছিল একসময়। এখন প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। এখন দিন বদলে গেছে। জবাবদিহিতার কাছে সবাই।”
নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিজের বিদ্যালয়ে এমন প্রতিশ্রুতি পূরণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন পলক।
“আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ যোগাযোগ মাধ্যমই এক ধরনের সাংবাদিকতা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ কাজটাই করছে।”
বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ‘হ্যালো. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’। শিশুদের পরিচালনায় এটি বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট।
শিশুদের উৎসাহ দিয়ে পলক বলেন, “আমাদের শিশুদের সামনে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নেই, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের গড়ার সুযোগ তাদের সামনে। নিজের জন্য নয়, বিশ্বমানবতার জন্যে সাহসিকতার সঙ্গে তারা এ পেশাটাই বেছে নিচ্ছে।”
শিশুদের করতালিতে ভাসে পলকের বক্তব্য। সামনে বসে থাকা শিশুরা আরো শুনতে আগ্রহ দেখায়।
পলক বলেন, “সেখানে সত্য, ন্যায়ের পথে, সততার বিষয়ে আমাদের সজাগ হতে হবে।”
শিশু সাংবাদিকদের মনোসংযোগ টানতে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দেন-‘নিউজ’ এর মানে কে জানে? চারদিক থেকে সমস্বরে জবাব আসে-‘নর্থ, ইস্ট, ওয়েস্ট, সাউথ’।
“মানে তোমার চারদিকে সব কিছু তোমাকে কাভার করতে হবে। সব তথ্য তোমাকে জানতে হবে। এ তো বড় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সাংবাদিকতা হচ্ছে সমাজের আয়না।”
কক্সবাজারের ১৭৩ জন শিশু সাংবাদিকের পাশাপাশি আগামীতে হাজার হাজার শিশু সাংবাদিক আসবে বলে প্রত্যাশা জানান প্রতিমন্ত্রী।
হ্যালোর সাংবাদিক বাছাইয়ে ‘আমার কথাও যাবে বহুদূর’ এই স্লোগানে এই কর্মসূচি ২৩টি জেলায় সোমবার একযোগে শুরু হয়েছে।
জন এফ কেনেডির একটি উক্তির কথাও শিশুদের স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
“দেশের জন্য কাজ কর। দেশ তোমাকে কী দিল তার চেয়ে দেশকে কী দিয়েছ, তা ভাবতে হবে। দেশ তোমাকে বিনামূল্যে বই দিয়েছে, স্কুলে পড়িয়েছে..। কেনেডি তাই বলেছেন- দেশের জন্য তোমরা কী করেছ?”
ঘুমে স্বপ্ন না দেখে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার আহ্বানও জানান তিনি।
সার্ফার জাফর আলমকে মঞ্চে তুলে এনে পলক বলেন, জাফর কক্সবাজারের আইকন। কক্সবাজারের নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
“ওর মতো হতে হবে। সার্ফিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বে তুলে ধরেছে। ওর জীবনের সংগ্রাম তোমাদের উৎসাহ জোগাবে।”
শিশুদের সফলতার সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে পলক বলেন, “তোমরা সফল হও। বাংলাদেশে যে যেখানে থাক, বিশ্বে যেখানে থাক, নেতৃত্ব দাও। বঙ্গবন্ধুর কথাও স্মরণ কর-সোনার বাংলা গড়তে গেলে সোনার মানুষ গড়তে হবে।”
এরপর প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে স্মারক নিতে শিশু সাংবাদিকরা যখন মঞ্চে, তাদের নিয়ে গান গেয়ে ওঠেন পলক।
‘মা গো ভাবনা কেন...তোমরা ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’- পুরো অনুষ্ঠান মাতিয়ে তোলেন এই প্রতিমন্ত্রী।
‘তারা জাগতে চায়, জাগাতে চায়’
শিশু সাংবাদিক উৎসবে সূচনা বক্তব্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী শিশুদের আগ্রহ দেখে তাদের বহুদূর যাওয়ার প্রত্যাশা প্রকাশ করেন।
“তাদের আগ্রহ রয়েছে, উৎসাহ রয়েছে। তারা জানতে চায়, জানাতে চায়। তারা জাগতে চায়, জাগাতে চায়।”
শিশুদের জন্য করার বিষয়ে নিজের আক্ষেপের কথাও জানান দুই যুগের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
“আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এ ব্যর্থতা ছাপিয়ে তোমরা এগিয়ে যাবে। তোমরা আমাদের যে ব্যর্থতার গ্লানি সেগুলো মুছে দেবে।”
রাজনীতির মধ্য দিয়ে উঠে আসা পলকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, তার মন্ত্রণালয়ের আংশিক সফলতা এলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে।
“শিশুদের সামনে রোল মডেল দরকার। আমি মনে করি, এ প্রতিমন্ত্রী তাদের সামনে সত্যি সত্যি আদর্শ।”
আট বছর আগে বাংলাদেশে বসে ইন্টারনেটে সংবাদ প্রচারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাহসী উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমানে চার কোটি ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। মোবাইল টেলিফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১০ কোটির ওপরে।
“৪ কোটি ইন্টারনেট সংযোগ যেখানে, যেখানে দেশের সব সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা ১০-১২ লাখ; সেখানে ইন্টারনেট সংযোগের ১০ ভাগও সংবাদ পড়ার জন্য ব্যবহার করা হলে তা দাঁড়ায় ৪০ লাখ।”
“এ দেশ এগিয়েছে। হয়ত যতটা এগোনোর কথা ততটা এগোয়নি। যে জন্যই আমরা তোমাদের ওপর নির্ভর করতে চাই,” শিশু সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক।
সাংবাদিকতার ২৭ বছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাংবাদিকতার কিছু মৌলিক নীতিমালা রয়েছে। শিশুদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা শেখানোর চেষ্টা করা হবে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় বই তৈরি করা হয়েছে।
শিশুদের সাংবাদিকতায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পথিকৃতের ভূমিকা পালনের কথা তুলে ধরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, এই মডেলটি বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার কথাও হচ্ছে।
গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “শুধু গণমাধ্যম যদি ঠিক মতো কাজ করে এদেশের গণতন্ত্র সংহত হতে পারে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সংহত হতে পারে ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আরো কার্যকর হতে পারে।”
মাঝখানে রাখা হয়েছে শিশুদের। এক পাশে অভিভাবক ও অন্যপাশে অতিথিরা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক জানালেন, আসন বিন্যাসের এমন ব্যবস্থা শুধু শিশুদের জন্য। এখানে কোনো প্রধান অতিথি নেই। নেই কোনো বিশেষ অতিথি। সবচেয়ে যারা গুরুত্বপূর্ণ তারা আমাদের সব।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে কল্যাণ পালের নেতৃত্বে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কক্সবাজার জেলা সংসদ, রাজীব দাশের নেতৃত্বে ঝিনুক মেলা খেলাঘর আসর ও ফাতেমা আক্তার মাথিনের নেতৃত্বে রাখাইন শিল্পী গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে।