চা বাগান ঘিরে প্রজন্ম

কম মজুরি আর নানা প্রতিবন্ধকতায় চা বাগানেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ‍আটকে আছেন শ্রমিকরা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্ত, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2014, 03:57 AM
Updated : 22 August 2014, 12:24 PM

জীবনের পুরোটা সময় চা বাগানে কাটালেও মজুরি বাড়ে যৎসামান্য। সারা দিনের পরিশ্রমের পর জীবিকার তাগিদে অন্য কোনো কাজও করতে পারেন না তারা।

মজুরির এতো অল্প টাকায় পরিবারের ভরণ-পোষণই দায়। এরপর সন্তানদের লেখাপড়ার পিছনে অর্থ ব্যয়ের চিন্তাটা হয়ে ওঠে ‘কল্পনাপ্রসূত’।

তাই চা বাগানের শ্রমিকের সন্তানরাও পূর্বপুরুষের পেশাই বেছে নেন। বাগানেই আটকে যায় তাদের জীবন।

বংশ পরম্পরায় চা শ্রমিকের কাজ করা মানুষগুলোর এক বেলা কাজের বিনিময়ে বেতন জোটে মাত্র ৬৯ টাকা।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের রাঙাপানি ‍চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের দরিদ্র জীবনের কাহিনী।

চা বাগানের শ্রমিক লাল মোহন উড়াংয়ের বয়স ৫০ বছর। এক ছেলে, দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ‍তার সংসার।

লাল মোহন জানান, সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কাজ করে বেতন পান ৬৯ টাকা। দিনে দুই বেলা কাজ করলে পান ১৩৮ টাকা।

আগে এ বেতন ছিল আরো কম। ছয়-সাত বছর আগেও একবেলা কাজের জন্য ৩২ টাকা পেতেন তারা।

ছবি: মুস্তাফিজ মামুন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: মুস্তাফিজ মামুন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছেলে-মেয়েরাও এখন চা বাগানে কাজ করেন জানিয়ে লাল মোহন বলেন,“মজুরির টাকা দিয়ে সংসার চালাতেই কষ্ট হতো। তাই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানোর কথা ভাবা হয়নি।”

রাঙাপানি চা বাগানে লাল মোহনের মত মোট এক হাজার ছয়শ শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে মাত্র ৪২৫ জন স্থায়ী শ্রমিক। অন্যরা অস্থায়ী।

স্থায়ী শ্রমিকদের প্রতি বেলার মজুরি ৬৯ টাকা হলেও অস্থায়ীরা পান ৬০ টাকা করে।

এই বাগানে প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন শ্রমিক কসম রায়। তার চার ছেলে আর তিন মেয়ের সবাই বাগান শ্রমিক।

অতিরিক্ত আয়ের আসায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আশপাশের গ্রামগুলোতে দিনমজুরের কাজ করেন কসম। সেখানে দৈনিক মজুরি পান ৩০০ ‍টাকা করে।

বাগান এলাকার বাসিন্দা ধনা রায় (৭০)।  আগে বাগানে কাজ করলেও এখন তিনি অবসরে। চা বাগানের শ্রমিকরা অবসরে গেলে কোনো ভাতা বা সুবিধা পান না বলে জানান তিনি।

ছবি: মুস্তাফিজ মামুন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: মুস্তাফিজ মামুন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

বরুণ রায় নামের আরেক শ্রমিক জানান, বাগানের শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য আগে কোনো স্কুল ছিল না। এ কারণে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পেত না। তাই এখানকার তরুণদের প্রায় সবাই নিরক্ষর।

অবশ্য ১৯৯৮ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে বাগান সংলগ্ন এলাকায় একটি স্কুল গড়ে ওঠে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেটি সরকারি হয়।

জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি অধিকার আদায়েও ‍আন্দোলন করতে হয় বাগান শ্রমিকদের।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি তপন দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭৪ সালে বাগানের মালিক ছিল সমথ কোম্পানি।

“তখন বাগানের জমি বর্গা নিয়ে শ্রমিকরা চাষ করত। ধান চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ওই বছর মালিক পক্ষ শ্রমিকদের চাষ করা জমি থেকে জোরপূর্বক ফসল তুলে নেয়। তখন ফসল রক্ষায় আন্দোলন করে জেল-জুলুমও সইতে হয় শ্রমিকদের।”