সওজ নিয়ে খবর: দুই সাংবাদিক কারাগারে

দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সময় সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তার করা এক চাঁদাবাজির মামলায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পটুয়াখালী প্রতিনিধিসহ দুই সাংবাদিককে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2014, 10:17 AM
Updated : 20 August 2014, 03:08 AM

এই দুই সাংবাদিক হলেন- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঞ্জয় কুমার দাস এবং মাছরাঙা টেলিভিশনের পটুয়াখালী প্রতিনিধি মো. জলিল।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নাইন- এর পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধি রাজিব বসু জানান, দুই সাংবাদিক মঙ্গলবার আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করলে পটুয়াখালীর বিচারিক হাকিম তপন কুমার দে তা নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

রাজিব আরো জানান, পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ বিভাগের অপসারণ করা পুরনো বেইলি ব্রিজের ইস্পাত ও লোহার যন্ত্রাংশ ‘নিলাম জালিয়াতির মাধ্যমে’ তিনটি ‘অস্তিত্বহীন’ প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির একটি অভিযোগ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন সঞ্জয় কুমার দাস।

ওই অনুসন্ধান চলাকালে গত ২৫ এপ্রিল পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. হাসান আল মামুন পটুয়াখালী সদর থানায় একটি মামলা করেন, যাতে সঞ্জয় ও জলিলসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরো ৫/৬ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়।

ওই নিলামের মালামাল বুঝিয়ে দিতে সড়ক ও জনপদ বিভাগ পাঁচ সদস্যের যে কমিটি করেছিল, হাসান আল মামুন তারই একজন সদস্য।

সঞ্জয় কুমার দাসের ওই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে গত ৮ মে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল “অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে সওজের সম্পদ `আত্মসাত'”।

এরপর হাই কোর্টে জনস্বার্থে একটি রিট আবেদন হয়, যার ভিত্তিতে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ বিভাগের বিরুদ্ধে পুরনো মালামাল নিলামে বিক্রিতে জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।

ওই নিলাম প্রক্রিয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে একটি রুলও জারি করে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চ। 

এদিকে সদর থানার এসআই আজহার চাঁদাবাজির অভিযোগের তদন্ত শেষে গত ৩১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেন। আগামী ২৮ অগাস্ট মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে।

সঞ্জয় কুমার দাস

‘অস্তিত্বহীন’ তিন প্রতিষ্ঠান

পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ (সওজ) দপ্তর থেকে পাওয়া নথি থেকে জানা যায়, ব্যবহার অনুপযোগী ৬০ টন স্টিল ও লোহার মালামাল নিলামে বিক্রির জন্য ১১টি গ্রুপে ভাগ করে চলতি বছর দরপ্রস্তাব আহ্বান করে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ দপ্তর।

এর ভিত্তিতে সোনালী ব্যাংকের নিউটাউন শাখায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৯ টাকা জমা দেখিয়ে গত ১১ মার্চ নাজমা এন্টারপ্রাইজ, ১ লাখ ৫৯ হাজার ৩১৫ টাকা জমা দেখিয়ে গাজী ট্রেডিং এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৯ টাকা জমা দেখিয়ে কর্ণফুলী ইঞ্জিনিয়ারিং নামের তিন প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পায়।

নথিতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই ঠিকানা দেখানো হয়- খুলনা মহানগরীর ৩৪ শেখপাড়া, মেইন রোড।  কিন্তু সেখানে গিয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পাননি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক।

ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে ৬ তলা একটি ভবন, যার মালিকের নাম ডা. বজলুল হক।

ওই বাড়ির প্রহরী শেখ ফজর আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ওই ঠিকানায় কোনো ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নেই। বাড়ির মালিক পরিবার নিয়ে তৃতীয় তলায় থাকেন। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি শাখা।

চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় একটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল চালান বাড়ির মালিক বজলুল হক। ষষ্ঠ তলা ব্যবহৃত হয় ট্রেনিং স্কুলের স্টোর রুম হিসাবে।  আর নিচ তলায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গার পাশাপাশি প্লাস্টিক ফার্নিচারের শো রুম ও একটি মুরগির ফার্ম রয়েছে।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সিনিয়র লাইসেন্স অফিসার মো. মোজাম্মেল হোসেন মিলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খুলনা প্রতিনিধিকে জানান, ওই ঠিকানায় মের্সাস গাজী ট্রেডিং কর্পোরেশন, মেসার্স কর্ণফুলী ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেসার্স নাজমা এন্টারপ্রাইজের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স দেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ (সওজ) দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম গত মে মাসে বলেন, “ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন কি না তা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি সর্বোচ্চ দরদাতা যাকে পেয়েছি তাকেই কার্যাদেশ দিয়েছি।”

পটুয়াখালী সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম সে সময়  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উন্নয়নমূলক কাজ করতে গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু ক্রটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে।… আপনারা সাংবাদিক, আমরা আপনাদের মেহমান, নির্বাহী অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা করবেন”।

চাঁদাবাজির মামলা

পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী হাসান আল মামুনের দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়,সঞ্জয় দাসসহ আরো একজন স্থানীয় সাংবাদিক ও অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জন গত ২৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় তার সরকারি বাসভবনে গিয়ে তার ভাইকে নানারকম ভয়ভীতি দেখান এবং গালাগালি করে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।

এজাহারে আরো বলা হয়, ঘটনার আধ ঘণ্টা পর পটুয়াখালী টোল প্লাজায় গিয়ে সেখানে কর্মরত কার্য পরিদর্শক আবদুর রহমান ও আবুল বাশারকে আসামিরা ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন এবং গালাগালি করে আবদুর রহমানের পকেট থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে যান।

সাংবাদিকরা কেন টাকা চেয়েছিল জানতে চাইলে হাসান আল মামুন পরদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন পারপাসে তারা আমার কাছে চাঁদা দাবি করছিল। তারা আমাকে বলে, ‘আপনি তো এখানে অনেক টাকা পেয়েছেন। এখান থেকে আমাদের এত টাকা দেন’।

“আমি বলেছি, আমি এখানে ঢুকলামই নতুন, আমি কোথা থেকে টাকা দেব।”

‘অস্তিত্বহীন’ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উপ সহকারী প্রকৌশলী বলেন, “এসব কাগজপত্র যাচাই বাছাই করা নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব। কার্যাদেশ অনুযায়ী মালামাল বুঝিয়ে দেয়ার কাজটি তার। এর জন্য আলাদা কমিটি রয়েছে, তারা ভাল বলতে পারবেন।”

নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যদের কাছে না চেয়ে তার কাছে কেন আসামিরা চাঁদা চাইলেন- এমন প্রশ্নে আল মামুন বলেন, “এ বিষয়ে তারাই (আসামিরা) ভাল বলতে পারবেন।”

সওজের ‘দুর্নীতি’ তদন্তের নির্দেশ

গত ৮ মে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সওজের নিলামে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নাইন-এর পটুয়াখালী প্রতিনিধি রাজিব বসু জনস্বার্থে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।

আবেদনকারীর আইনজীবীরা শুনানিতে বলেন, পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদ বিভাগের বেইলি ব্রিজের ইস্পাত ও লোহার কোটি কোটি টাকার মালামাল মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় অস্তিত্বহীন তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে নিলামে বিক্রি করা হয়।

নিলাম প্রক্রিয়ায় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি বলেও রিট আবেদনে অভিযোগ করা হয়।

ওই আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চ জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেয়। একইসঙ্গে ওই নিলাম প্রক্রিয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চায় আদালত।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সচিব, সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এবং বরিশাল সড়ক ও জনপদের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও নির্দেশ দেয় আদালত।