পঞ্চম দিনে উদ্ধার অভিযানে জরিপ-১০

ডুবে যাওয়া লঞ্চের অবস্থান জানতে পদ্মায় ৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় চার দিন ধরে নিষ্ফল তল্লাশির পর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় উদ্ধার অভিযানে যোগ দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্ভে ভেসেল জরিপ-১০।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2014, 03:43 AM
Updated : 8 August 2014, 07:32 AM

বিপুল আয়োজন নিয়ে উদ্ধারকর্মীরা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলেও শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পিনাক-৬ নামের লঞ্চটির অবস্থান চিহ্নিত করা যায়নি, ফলে সেটি উদ্ধারের কাজও শুরু করা যায়নি।

এদিকে গত তিন দিন ধরে দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে পদ্মা, মেঘনাসহ কয়েকটি নদীর ভাটিতে বিভিন্ন স্থানে লাশ ভেসে উঠছে।তীব্র স্রোতে লাশ পৌঁছে গেছে বঙ্গোপসাগরের কাছাকছি ভোলা পর্যন্ত।

ডুবে যাওয়া লঞ্চটিও স্রোতের কারণে দুর্ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরে গেছে বলে উদ্ধারকর্মীদের ধারণা।

তারা বলছেন, বর্ষা মওসুমে পদ্মায় যে পরিমাণ পলি আর বালি থাকে তাতে চার দিনে নদীর তলদেশে পিনাক-৬ কাদার নিচে ঢাকা পড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অবস্থান সনাক্ত করা গেলেও সেটি উদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।   

বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “দুর্ঘটনাস্থলে প্রবল ঘূর্ণাবর্ত, পানির গভীরতা সেখানে ৮০/৯০ ফুট। ঘূর্ণাবর্তের কারণে নদীর তলদেশে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে, আবার বালু জমা হচ্ছে। ফলে লঞ্চটি দূরে সরে গিয়ে বালুর নিচে চাপা পরে থাকতে পারে।”

লঞ্চের অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারায়  উদ্ধারকারী জাহাজ ‘নির্ভীক’ ও ‘রুস্তম’ মাঝ পদ্মায় অলস বসে আছে। জরিপ-১০ এর সঙ্গে তল্লাশি অভিযানে আছে টাগ বোট কাণ্ডারি-২, অনুসন্ধান জাহাজ সন্ধানী, তিস্তা ও নৌবাহিনীর এলসিটি-০১২।

নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম বলেন, “জরিপ-১০ আকারে ছোট হলেও এর কার্যক্ষমতা বেশি। চলার পথে দুই পাশে প্রায় ৩শ’ মিটার পর্যন্ত স্ক্যান করতে পারে। পাশাপাশি পানির নিচে পলিমাটি ও কাদামাটিতে ৭০ মিটার এবং বালি মাটিতে ১৮ মিটার গভীর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ চালানোর ক্ষমতা রয়েছে এর।”

সোমবার বেলা ১১টার দিকে কাওড়াকান্দি থেকে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়া ঘাটে যাওয়ার পথে লৌহজং ক্রসিংয়ে পিনাক-৬  ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ১১০ জনকে উদ্ধার করা হয় বলে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসনের দাবি।

বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত নদীতে মোট ৩৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে ২৩ জনের পরিচয় জানার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল।

স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে মাওয়ায় জেলা প্রশাসনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ যে তালিকা করেছে, তাতে ১৩০ যাত্রী এখনো নিখোঁজ।

উদ্ধার হওয়া লাশগুলো যাতে স্বজনরা সহজে সনাক্ত করতে পারেন সেজন্য মঙ্গলবার রাত থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাঁচ্চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক জিএসএম জাফরুল্লাহ জানান, লাশ সনাক্ত করার জন্য ইউএনও ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। নিহতদের লাশের ছবি, পোশাকের বর্ণনা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানের চিহ্ন দেখে সনাক্তের পর ফরম পূরণের মাধ্যমে কমিটি স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করছে।

এদিকে দীর্ঘ সময় পানিতে থাকা লাশগুলো সনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে উদ্ধার হওয়া লাশের অর্ধেকই এখনো হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে লাশ সনাক্তের জন্য ডিএনএ টেস্টের দাবি করেছেন স্বজনরা।

মুন্সীগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার মিয়া মো. কুতুবুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত ভোলা থেকে ১০ জন, শরীয়তপুর থেকে আটজন, বরিশাল থেকে আটজন, চাঁদপুরে পাঁচজন, লক্ষ্মীপুরে একজন, মাদারীপুরে একজন ও ঘটনাস্থল মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

যে ২৩ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তদের মধ্যে ১৯ জনের নাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে আছে।

এরা হলেন- মাদারীপুরের শিবচর থানার গোয়াখোলা গ্রামের নুরুল হকের মেয়ে নুসরাত জাহান হীরা (২২),  একই এলাকার উত্তারাইল গ্রামের আলম শেখের স্ত্রী হাসি বেগম (৩৮), সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের খালাশিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ইনা আক্তার (২২), হায়দার চৌকিদারের মেয়ে ইমা (১৮), রহিম মাদবরের মেয়ে ইপা আক্তার (১৪), রহিম মাদবরের ছেলে ইব্রাহিম (১ বছর ৭ মাস); শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশ পাড়া গ্রামের আবদুল জব্বারের মেয়ে জান্নাতুল নাইম লাকী (২৫), নড়িয়ার সুরেশ্বর থেকে উদ্ধার হওয়া মাদারীপুরের শিবচরের নুরুল ইসলাম হাওলাদারের ছেলে মিজানুর রহমান (৩৫), তারা মিয়ার ছেলে নুরে আলম (১৪)।

এছাড়া ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার আব্দুল হাইয়ের মেয়ে রিতা আক্তার (২৫), সদরপুর উপজেলার আজিজ মাদবরের ছেলে আবু ইউসুফ (২২), একই উপজেলার সাতরশি গ্রামের রুবেলের মেয়ে ফাইজা (৭), মানিকনগর উপজেলার সালমা নগরকান্দা গ্রামের মনির উদ্দিন ফকিরের ছেলে জামাল হোসেন (২৭), সালতার সৈয়দ সাদির মেয়ে ইনাম (৫) ও তার মা শেফালী বেগম (২৮); গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইব্রাহিম হোসেনের মেয়ে ইশরাত হোসেন মিম (১৩), বরিশালের বাকেরগঞ্জের শহীদুল ইসলাম জমাদ্দারের ছেলে জাহিদ হোসেন (১৫), হানিফ মাস্টারের ছেলে জাকির হোসেন জুলহাস (৪০) ও ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার লুৎফর রহমান আকনের ছেলে ফাহাদ হোসেন আকনের (২৪) লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজদের জন্য শুক্রবার জুমার পর মুন্সীগঞ্জ ও মাদারীপুরের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া করা হবে।