শুক্রবার ভোরে বারোবাজার রেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই বাসের অর্ধ শতাধিক যাত্রী। আলাদা মাইক্রোবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেছেন বর ও কনে। কয়েক মুহূর্ত আগেই রেল লাইন পার হয়ে যায় তাদের মাইক্রোবাস।
এভাবে দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে বরের গ্রাম শৈলকুপা উপজেলার কাজীপাড়া ফুলহরিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বধূবরণের আয়োজন সেখানে রূপ নেয় শবযাত্রার মিছিলে।
কালীগঞ্জ উপজেলার সাকো মথনপুর গ্রামের সুবাস কুমারের মেয়ে জ্যোৎস্না বিশ্বাসের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে বিয়ে হয় ফুলহরি গ্রামের সাধন কুমার বিশ্বাসের ছেলে তাপস কুমার বিশ্বাসের। বিয়ের পর বউ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঘটে এ দুর্ঘটনা।
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম জানান, সৈয়দপুর থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ভোর পৌনে ৪টার দিকে বারোবাজার রেলক্রসিং পার হচ্ছিল। এ সময় বরযাত্রীবাহী বাসটি রেল ক্রসিংয়ে উঠে পড়লে সংঘর্ষ ঘটে।
“ট্রেনের ধাক্কায় বাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। ওই অবস্থায় ট্রেনটি প্রায় আধা কিলোমিটার পথ বাসটিকে ঠেলে নিয়ে থেমে যায়।”
খবর পেয়ে স্থানীয় জনতা, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার কাজ শুরু করেন। তারা ঘটনাস্থল থেকে শিশু ও নারীসহ নয় জনের লাশ উদ্ধার করেন।
পরে আহত অবস্থায় কালীগঞ্জ হাসপাতাল ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে আরো দুজনের মৃত্যু হয় বলে কালীগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান।
নিহতদের মধ্যে দশজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন- শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি কাজীপাড়ার সুধীর কুমার (৪০), বিপ্লব বিশ্বাস (২৫), সুজয় সাহা (৩০), শোভন দে (২), ও অলক কুণ্ডু; কালীগঞ্জের নিশ্চিন্তপুরের গৃহবধূ বন্যা রানী (৩৫) তার ছেলে কৌশিক অধিকারী (৮) এবং বন্যার ননদ কলেজছাত্রী কৃষ্ণা (২০) এবং ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের বিমল বিশ্বাস (৪৫) ও উজ্বল দাস (২৫)।
আহতদের মধ্যে ৩৯ জনকে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ১৬ জনকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত বাসযাত্রীদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
তবে বাসের চালকের বিষয়ে পুলিশ কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
জেলা প্রশাসক জানান, বর ও কনে ছিলেন সামনের একটি মাইক্রোবাসে। তাদের গাড়ি রেললাইন পার হয়ে যাওয়ার পরপরই পেছনে বরযাত্রীদের বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে।
ওই বাসের যাত্রী ফুলহরির বাসিন্দা নিমাই সাহা জানান, রেলগেইট খোলা পেয়ে চালক কোনো কিছু না ভেবেই গাড়ি লাইনে উঠিয়ে দেন। এরপরই প্রচণ্ড শব্দে সংঘর্ষ হয় এবং ট্রেনের ইঞ্জিন বাসটিকে ছেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে।
এ সময় প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে অনেকেই বাসের জানালা দিয়ে ছিটকে পড়েন। বাসে থাকা প্রায় ৭০ জন আরোহীর সবাই কম বেশি আঘাত পান।
এ ঘটনার জন্য বারোবাজারের স্টেশন মাস্টার আবু সানিয়াব ও গেইটম্যান আবদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে দুর্ঘটনার পর সীমান্ত এক্সপ্রেসের সঙ্গে আটকে বাসটি লাইনের ওপর পড়ে থাকায় খুলনার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
খবর পেয়ে পাকশী থেকে রেলের বিভাগীয় ম্যানেজার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। খুলনা থেকে রিলিফ ট্রেন ঝিনাইদহে পৌঁছালে শুরু হয় উদ্ধার কাজ। বাসটি সরিয়ে নিলে প্রায় সাত ঘণ্টা পর বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে এই কমিটিকে।
এছাড়া রেলের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটিকেও এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে বর-কনের মাইক্রোবাস যখন বরের গ্রাম কাজীপাড়া ফুলহরিতে পৌঁছায়, ততোক্ষণে পুরো গ্রামে শোকের স্তব্ধতা নেমে আসে।
ফুলহরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ জানান, দুর্ঘটনার খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। বিকালে লাশগুলো গ্রামে পৌঁছানোর পর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
“এতোগুলা মানুষ একসঙ্গে মারা গেল… এই গ্রামের মানুষ এই শোক ভুলবে কেমন করে,” বলেন তিনি।