‘বাল্যবিয়ে রোধে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার’

বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রিয়াজুল বাশার লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2014, 05:43 PM
Updated : 23 July 2014, 06:24 AM

পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই বাল্যবিয়ে কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

মঙ্গলবার লন্ডনের ওয়ালওয়র্থ একাডেমিতে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে দেয়া ভাষণে একথা বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “প্রথমত আমি মনে করি, বাল্যবিবাহের মতো সংবেদনশীল সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

“এবং আমি মনে করি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে... এগুলো যদি আমরা করতে পারি তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাল্যবিবাহ কমে আসবে।”

নারীর উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হল- প্রতিটি মেয়ে যথাযথ শিক্ষিত হবে এবং এরপর চাকরি করবে; যাতে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে- সে লক্ষ্যেই আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি।”

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ‘নারীর খৎনা প্রতিরোধ এবং জোরপূর্বক ও বাল্যবিবাহ নির্মূল’কে মূল প্রতিপাদ্য ধরে বিশ্বে প্রথমবারের মতো গার্ল সামিট আয়োজন করেছে যুক্তরাজ্য, যাতে সহ-আয়োজক হিসেবে রয়েছে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ।

এই সম্মেলনে ৫৫টি দেশ থেকে প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে সরকার প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ছিলেন। সম্মেলনের উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও ছিলেন।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “এমডিজির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অর্জন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে সামাজিক আন্দোলন তার ভূয়সী প্রসংশা করেছেন ডেভিড ক্যামেরন এবং সেজন্যই তিনি গার্ল সামিটে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।”

সকাল থেকে ভিন্ন ভিন্ন সেশনে অনুষ্ঠান চলার পর উচ্চ পর্যায়ের অধিবেশনে শেখ হাসিনা উপস্থিত হন স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে।

উপস্থাপক ব্রডকাস্টার জেইনাব বাদাবি শেখ হাসিনাকে মাঝখানে বসিয়ে তার একপাশে বসান বুরকিনাফাসোর ফার্স্ট লেডি স্যান্তাল কমপাওরে এবং অন্যপাশে বসান পাকিস্তানের কিশোরী মানবাধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাইকে। শেষ পর্বে এসে যোগ দেন ডেভিড ক্যামেরন।

অধিবেশনের শুরুতে উপস্থাপিকা অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলেন, “তারসম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। বিশ্বে নারীর অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষ জায়গায় রয়েছেন তিনি।”

এরপর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা পর্বের পর প্রশ্নোত্তর শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাল্যবিয়ে রোধে তার সরকারের নেয়া নানা ধরনের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

শেখ হাসিনা বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা ও বৃত্তি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার সরকারের, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে এক লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে।

সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে গত দুই দশকে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে কমে এসেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হলেও দুই দশক আগে বাংলাদেশের ৫২ শতাংশ নারীর বিয়ে হত ১৫ বছর বয়সের মধ্যে, বর্তমানে তা ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের বাধা সত্ত্বেও ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতিমালা করেছে তার সরকার। শাস্তির বিধান রেখে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইনও সংশোধনের কাজ চলছে।

শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য দেশে প্রথম শিশু আইন, ২০১১ করা হয়েছে।

“তবে শুধু আইন প্রণয়ন করেই বাল্যবিবাহ দূর করা যাবে না। এরজন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ প্রয়োজন,” বলেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশে মেয়েদের কলেজ পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, মাধ্যমিক পর্যন্ত বৃত্তি ও নগদ সহায়তাসহ সব ধরনের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দেয়া হচ্ছে বলেও সম্মেলনে জানান তিনি।

গার্ল সামিটে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, বুরকিনাফাসোর ফার্স্ট লেডি স্যান্তাল কমপাওর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তালেবান হামলায় আহত পাকিস্তানের কিশোরী মালালা ইউসুফজাই।

“পাশাপাশি স্নাতক পাস নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো হচ্ছে; যার ফলে এখন দেশের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের ৬০ শতাংশই নারী। তারা দৈনন্দিন জীবনযাপনে সিদ্ধান্ত দিতে পারছে।”

এসময় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও নারী উন্নয়নে বিভিন্ন কমিউনিটি প্রোগ্রামের কথাও তুলে ধরেন তিনি।

গার্ল সামিটে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি অঙ্গীকারনামা উপস্থাপন করা হয়, যাতে বলা হয় ২০৪০ সালে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিয়ে নির্মূল হয়ে যাবে।

গার্ল সামিট আয়োজনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, নারীর খৎনা এবং জোরপূর্বক ও বাল্যবিয়ে নারীর অধিকার খর্ব করবে ও তাদের বিকাশে ‘প্রতিবন্ধকতা’ সৃষ্টি করছে এবং এতে নির্যাতনেরও শিকার হতে হচ্ছে নারীদের।

নারীর খৎনা মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকলেও বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ে রয়েছে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে। বিশ্বে এখন ২০ থেকে ২৪ বছরের যে নারীরা রয়েছেন তাদের এক তৃতীয়াংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে নারীর খৎনা, জোরপূর্বক ও বাল্য বিয়ে কমতে শুরু করেছে এবং সচেতনতা আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্মেলন হচ্ছে বলে উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে।