র‌্যাব ভেঙে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে এইচআরডব্লিউর চিঠি

গঠনের পর থেকে ৮০০ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য দায়ী করে বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনী র‌্যাবকে ভেঙে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2014, 07:37 AM
Updated : 21 July 2014, 05:47 PM

নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যাকাণ্ডে এই বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাবকে বিলুপ্ত করতে বিএনপির দাবির মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি এই চিঠি পাঠাল।

গঠনের সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা খালেদা জিয়া সন্ত্রাস দমনে গঠিত বিশেষ বাহিনী র‌্যাবকে এখন বিলুপ্ত করার দাবি তুললেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নাকচ করা হচ্ছে। 

২০০৪ সালে গঠনের শুরু থেকে র‌্যাবের কার্যক্রমের সমালোচনায় মুখর হিউম্যান রাইটস নতুন করে দাবি তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান মানবাধিকার সংগঠনটির বক্তব্য নাকচ করে বলেছেন, এই বাহিনী বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড কখনো ঘটায়নি।

র‌্যাব ভেঙে দেয়ার দাবি তোলার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস যুক্তি দেখিয়েছে, এই বাহিনীকে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভেঙে দেয়ার আগ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর সব সদস্যকে সরিয়ে নিয়ে র‌্যাবকে পুরোপুরি বেসামরিক বাহিনীতে পরিণত করারও দাবি জানানো হয়েছে চিঠিটিতে,  যে চিঠি পাঠানো খবর রোববার তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

এইচআরডব্লিউসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত এক দশক ধরে র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক বিচারবহির্ভূত হত্যা, আইনবহির্ভূতভাবে আটক ও আইনি কাঠামোর সুযোগ নিয়ে ‘পদ্ধতিগত’ নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে আসছে।

“স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে প্রায় ৮০০ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাব দায়ী,” বলা হয়েছে চিঠিতে।  

বিএনপি সরকারের আমলে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরবর্তী সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আওয়ামী লীগ সরকারও র‌্যাবের এসব কর্মকাণ্ডকে দায়মুক্তি দিয়ে এসেছে বলে মানবাধিকার সংগঠনটির দাবি।

এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়, “গত এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের ভাড়াটে খুনি হিসাবে কাজ করার তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর বাংলাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

“র‌্যাব সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার হয়ে ওই কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব যে আসলে একটি ডেথ স্কোয়াড হিসাবে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে- এটি তার আরেকটি উদাহরণ।”   

নারায়ণগঞ্জ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ

নারায়ণগঞ্জে সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণের তিনদিন পর তাদের লাশ পাওয়া যায় নদীতে।

টাকার বিনিময়ে সাতজনকে খুনের অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাবের দায়িত্বশীল তিন কর্মকর্তাকে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানোর পর আদালতের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের একজন বাংলাদেশ সরকারের এক মন্ত্রীর জামাতা।

এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশ সরকার র‌্যাব সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে এলেও তা পূরণে ‘পুরোপুরি ব্যর্থ’ হয়েছে।

“র‌্যাবকে এখন আর সংস্কার করে চালানো সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি না। আইনের ঊর্ধ্বে থেকে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করে র‌্যাব পরিচালনার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। এই অবস্থায় এ বাহিনীকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে, যাতে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হয়।”  

চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরের বেশ কয়েকটি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম হওয়ার অভিযোগ তদন্ত করেছে, যেসব ঘটনায় কখনো র‌্যাব এককভাবে, আবার কখনো পুলিশ কিংবা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সঙ্গে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

বিএনপিও অভিযোগ করে আসছে, সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে র‌্যাবকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে হত্যা অথবা গুম করছে।  

এ ধরনের ছয়টি ঘটনা খতিয়ে দেখে মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, অপরাধী হিসেবে আটকের পর নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন ওই সব ব্যক্তিরা, যা পরে কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে। তিনটি ঘটনায় অপরাধীদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সময় মারা গেছেন আটকরা। আর দুটি ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং ঘটনার পরিস্থিতি বিচার করে মনে হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।

সাদা পোশাকে আটকের ১০টি ঘটনাও খতিয়ে দেখা হয়েছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি। এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছে, সাদা পোশাকের ব্যক্তিরা পুলিশ কিংবা র‌্যাবের ছিলেন।

চিঠিতে বলা হয়, কিছু ক্ষেত্রে ‘র‌্যাব’ লেখা গাড়িতে করে অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। ওই ১০টি ঘটনার মধ্যে সাতটিতেই এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়াদের লাশ পরে বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে রাস্তার পাশে পাওয়া যায়। বাকিরা ‘গুম’ হয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময় জনসম্মুখে এবং ব্যক্তিগতভাবে র‌্যাবের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে চিঠিতে বলা হয়। 

চিঠিতে অ্যাডামস বলেন, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নারায়াণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর গত ১৪ মে র‌্যাব ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। আটকাবস্থায় মানুষ হত্যার দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই র‌্যাব ভেঙে দেয়া উচিত বলে সে সময় বলা হয়েছিল।

“তারপর আপনি র‌্যাবকে ভেঙে দেয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন এবং এই বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।”

চিঠিতে মূল যেসব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে-

১. র‌্যাব ভেঙে দিয়ে একে পূর্ণাঙ্গ বেসামরিক একটি বাহিনী হিসেবে তৈরি করা, যারা সংগঠিত অপরাধ এবং জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রেও মানবাধিকারের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করবে। নতুন এই বাহিনীর সদস্যদের কোনোভাবেই সশস্ত্র বাহিনী থেকে নেয়া হবে না।

২. বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মারাত্মক ধরনের অপরাধের সঙ্গে নতুন র‌্যাব বাহিনীর কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তাকে চিহ্নিত করা এবং বাহিনীর কর্মতৎপরতা মূল্যায়নের জন্য একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করতে হবে। আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে র‌্যাব পুনর্গঠনের জন্য এ কমিটিকে জনগণের অভিযোগ শোনার ক্ষমতা দিতে হবে। কমিটির প্রতিবেদন জনসমউখে প্রকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৩. র‌্যাবের অভিযুক্ত সদস্যদের একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য একটি তদন্ত এবং বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। তদন্ত ও বিচারের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অপরাধ সম্পর্কে ধারনা থাকার পাশাপাশি অপরাধ প্রতিরোধ ও অভিযুক্তের সাজা নিশ্চিত করার কর্তৃত্ব থাকতে হবে।

র‌্যাব ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত কয়েকটি সুপারিশও প্রধানমন্ত্রীর কাছে রেখেছে এইচআরডব্লিউ। সেগুলো হলো-

১. র‌্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্যকে দ্রুত সরিয়ে নেয়া

২. সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের র‌্যাবে দ্বিতীয় সারির সদস্য হিসেবে ব্যবহারের  চর্চা বন্ধ করা এবং সেনা সদস্যদের ভবিষ্যতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করানোর  পদ্ধতি বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় আইনি পরিবর্তন আনা।