জল আটকে দুর্ভোগ: মহাপরিকল্পনা কাগজেই

দোষারোপের দোলাচলে হিমাগারেই পড়ে আছে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2014, 03:52 PM
Updated : 22 June 2014, 03:52 PM

আগামী বছর এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মেয়াদ ফুরাতে চললেও তার আগের বছরও নগরবাসীকে ডুবতে হয়েছে বর্ষার জলে। আর মেয়র মনজুর আলমের মেয়াদও শেষ হচ্ছে আগামী বছর।

মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবাই একমত হলেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় আগামী কয়েক বছরও এই দুর্যোগ থেকে নগরবাসীর মুক্তির কোনো ইঙ্গিত মিলছে না।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হওয়া মেয়র বারবার অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন এর দায় নিতে। আর ক্ষমতাশীল দলের মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর দায়ভার বিএনপি সমর্থিত বর্তমান মেয়রেরই।

গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা ভারী বর্ষণে বন্দর নগরীর অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে স্থবির হয়ে পড়ে নগর জীবন।

এরপর চট্টগ্রামের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়ে সরব হন। রোববার বাজেট ঘোষণা করতে গিয়ে প্রশ্নবানে জর্জরিত হন মেয়র মনজুরও।

গত শনিবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে স্থানীয় মন্ত্রী-সাংসদ ও মেয়রের উপস্থিতিতে এক সভায়ও জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।

এরপর রোববার চট্টগ্রামের সাংসদ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নেবেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

তবে তারা দু’জনই অসহনীয় মাত্রার জলাবদ্ধতার জন্য মেয়র হিসেবে মনজুরের অকার্যকারিতা ও উদ্যোগের অভাবের কথা বলছেন।

ভূমি প্রতিমন্ত্রী জাবেদ বলেন, “জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরাও খুব চিন্তিত। এটা নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করছি।

“জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের বিকল্প নেই মানছি। তবে মেয়র যদি নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিস্কার করতেন তবে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হত না।”

জলাবদ্ধতার দায় নিতে মেয়রের অস্বীকৃতির বিষয়ে চট্টগ্রামের এই সংসদ সদস্য বলেন, তিনি মেয়র পদে আছেন। তার সাফল্য এবং ব্যর্থতার দায়িত্ব তো তাকেই নিতে হবে।

এ বিষয়ে গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নালা পরিষ্কার না রাখলে জলাবদ্ধতা তো হবেই। উনি যে ট্যাক্স আদায় করেন তা কোন খাতে খরচ করেন?

“নগরী প্রধান সড়কে পর্যন্ত আর্বজনা ছড়িয়ে আছে। বর্তমান মেয়র অথর্ব। এখন দায়িত্ব এড়ালে তো হবে না। গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বহীন লোক থাকলে কাজ হয় ন।”

জলাবদ্ধতা নিরসনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি পরামর্শক দলের সহায়তায় ১৯৯৫ সালে তৈরি করা হয় ‘চিটাগাং স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টার প্ল্যান’। 

ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের প্রথম পর্যায়ে চাক্তাই খালের সমান্তরালে নগরীর ষোলশহরে ভূমিঅফিস থেকে বহদ্দারহাট হয়ে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত একটি নতুন খাল খননের প্রস্তাব করা হয়।

পাশাপাশি নগরীর মোগলটুলীতে একটি সেকেন্ডারি খাল খনন, চাক্তাই ও রাজাখালী খালের প্রবেশ মুখে নেভিগেশন গেইট স্থাপন এবং নির্ধারিত কিছু স্থানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য পুকুর খননের প্রস্তাব করা হয়।

এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ৯০০ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০ বছর।

মেয়র মনজুর আলম বলেন, প্রায় তিন বছর আগে বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত খাল খননের জন্য ২৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিলেন তিনি। তা এখন একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নকারী বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, সরকার মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করেছেন। অর্থাৎ মেয়াদের মধ্যে অর্থ দেয়ার বিষয়ে রাজি হয়েছেন।

“এখন টাকা কিভাবে চাইতে হয় তার কিছু বিধি আছে। ডিপিপি আকারে প্রকল্প প্রস্তাব করে মাস্টার প্ল্যানের আওতায় বরাদ্দ চাইতে হবে।”

আলী আশরাফ বলেন, “এভাবে আবেদন হয়নি বলে টাকাও আসেনি। আসলে অতীত ও বর্তমানে ক্ষমতায় ‍থাকা মেয়র ও রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন এটা সাময়িক সমস্যা। তাই গত ২০ বছরে কিছুই হয়নি।”

বরাদ্দ না পেলেও সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই মেয়র মনজুরের। তিনি বলেন, “আমি তো সরকারেই অংশ।

“আমি কে বা কী, সেটা বিষয় নয়। চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে সরকার আশা করি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। এতে হয়ত আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।”

প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে সিসিসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেন মেয়র।

সরকারি ‍অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী জাবেদ বলেন, মেয়র কিভাবে চেয়েছেন সেটা একটা বিষয়। পরিকল্পিতভাবে আবার চাইলে পাবেন।

প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, সরকার টাকা না দিলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হাজার-হাজার কোটি টাকা কী করে পায়। ঠিকভাবে তদবির করলে মেয়রও পাবেন।

মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, “মেয়র তো প্রকল্প পাঠিয়েই দায় শেষ করেছেন। সেটাই শুধু বলেন। দ্রুত নৌ পরিবহনমন্ত্রী ও পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। প্রাথমিকভাবে কিছু স্লুইস গেট নির্মাণ করতে হবে।”