তথ্য কমিশনের পাঁচ বছর পূর্তি নিয়ে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় পুরো কমিশনের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতা ও অধিকার কর্মীরা বলেন, তথ্য সরবরাহে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা ও তথ্য না দেয়ার মানসিকতা জনগণের মাঝে এ নিয়ে অনীহা তৈরি করেছে।
শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে ‘তথ্য কমিশন ৫ বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা মত দেন, তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা ও জনগণের তথ্য পাওয়ার উপায় আরো সহজতর করে সংশ্লিষ্টদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
তথ্য কমিশন ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রশাসনের প্রতিনিধিরা স্বীকার করে বলেন, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তথ্য পেতে মানুষের অনীহা রয়েছে। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি সংস্কার কাজও চলছে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
আলোচনায় অংশ নেন- প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ ফারুক, তথ্য কমিশনার ড. সাদেকা হালিম, মোহাম্মদ আবু তাহের, তথ্য কমিশনের সচিব মো. ফরহাদ হোসেন, সাবেক আইনমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরু, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম, বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির, রিসার্চ ইনেশিয়েটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, আর্টিকেল নাইনটিন পরিচালক (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া) তাহমিনা রহমান এবং একজন তথ্য সুবিধাভোগী শেখ আলী আহাম্মদ।
ক্যাসপারস্কির সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইট এবং একাত্তর টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হয়।
৯৭ শতাংশ তথ্য সরবরাহ করেছে কমিশন
শুরুতেই প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ ফারুক বলেন, তথ্য কমিশন আইন প্রণয়ন এ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এটা জনগণের আইন। এ আইন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর প্রয়োগ হয়।
প্রধান তথ্য কমিশনার বলেন, “৫ বছরে ৫টি ইউনিট করেছি-এটা বড় সফলতা। প্রথম বছরে আমরা ২৫ হাজার ৪১০টি আবেদন পেয়েছি। এরমধ্যে ৯৯ দশমিক ৭০ শতাংশ তথ্য দেওয়া হয়েছে। ৫ বছরে ৬১ হাজার আবেদন এসেছে। এরমধ্যে ৯৬ দশমিক ৯১ শতাংশ তথ্য দেওয়া হয়েছে।”
তথ্য অধিকার নিয়ে সচেতনতার জন্যে নানা প্রচারণার কথাও তুলে ধরেন মোহাম্মদ ফারুক।
যত বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে তত বেশি তথ্য দেওয়া সহজ হবে বলে জানান তিনি।
তথ্য পাওয়ায় এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে
প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেয়ার সময় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, তথ্য পেতে জটিলতা ও অসহযোগিতার উত্তরণে আরো কাজ করার প্রয়োজন ।
মানুষের অনীহা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে আইনের বাস্তবায়ন করতে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।
“যে কোনো নতুন আইনের বড় সমস্যা হচ্ছে এটার বাস্তবায়ন। একটি আইনের গভীরে গিয়ে বাস্তবায়ন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকে। তথ্য অধিকার আইন নিয়ে আরো কিছু করার সুযোগ রয়েছে।”
নজরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের বড় বিষয়টি হচ্ছে এর জবাবদিহিতা। তাতে প্রথমে চলে আসে তথ্য অধিকার আইনের কথা।
“এটাকে সেনসেটাইজ করার জন্যে আমরা কাজ করছি। এসব তথ্য যতটুকু সম্ভব স্বপ্রণোদিত হয়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশের সুযোগ রয়েছে।”
তিনি বলেন, অনেক সময় তথ্য সুবিন্যস্ত নয়। যথাযথভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে চাওয়ার বিষয় রয়েছে।
“প্রশাসনিক কাজ আশানুরূপ হতে আরো সময় লাগবে আমাদের। চেষ্টা করছি আমরা। এক সময় গোপনীয়তার বিষয় ছিল। এ আইনটি আসার পর তা সুচারু হয়েছে। এ আইনটি কার্যকর করতে অন্যান্য আইনেও কিছু সংশোধন করতে হবে। তা আমরা করছি।”
কোথায় যেন ফাঁক আছে
তথ্য অধিকার আইনের পক্ষের অন্যতম শীর্ষ কর্মী বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির বলেন, তথ্য অধিকার আইন হওয়ার পরও জনগণের সাড়া না পাওয়ায় মনে হচ্ছে কোথাও যেনো ফাঁক রয়েছে।
“জনগণের মধ্যে এক ধরনের অনীহা। কেন জানি মনে হচ্ছে, জনগণ মনে করছে এটা ঝামেলা, করে লাভ নেই- কোনো জায়গায় যেনো ফাঁক আছে। একটা পজিটিভ আইন থাকার পরও যেনো তথ্য চাওয়ার জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা।”
তথ্য পাওয়ার জটিল প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরে খুশি কবির মন্তব্য করেন, কিছু ‘ব্যুরোক্রেটিক’ সমস্যা থাকতে পারে।
তথ্য না দেয়ার মানসিকতা পাল্টাতে হবে
আলোচনার এই পর্যায়ে সাংসদ ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা না করে সহজে তথ্য দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ সভাপতি বলেন, “জনগণ জানতে চায়। জানার জন্যে কোথায়, কিভাবে যেতে হবে, তা তারা জানে না। এ নিয়ে জনসচেতনতার জন্যে কাজ করতে হবে।
তথ্য অধিকার আইনটি জনগণকে সহজে তথ্য দেওয়ার জন্য হলেও তা বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“জনসচেতনতা যথাযথভাবে হয়নি। এটা ইমপ্লিমেন্ট হচ্ছে না। এ জন্যে একটা মনিটরিং টিম করা দরকার।”
সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আপনি সার্ভেন্ট অফ রিপাবলিক। আপনি জনগণের অধিকারকে বাধা দেবেন এ অধিকার নেই। জনগণকে জানতে দিতে হবে। এ মানসিকতা পাল্টাতে হবে। তথ্য দেয়ার মানসিকতা করতে হবে।”
জনগণের অনীহার অনেক কারণ রয়েছে
বিদায়ী তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম বলেন, যেসব তথ্য মানুষ সহজে জানতে চায় তা অধিকাংশই মৌখিকভাবে জানতে চায়। কিন্তু জেলা পর্যায়ে যথাযথভাবে তা করা হয় না। এ পর্যন্ত ৬২ হাজারের মতো তথ্য পাওয়ার জন্য আবেদন পাওয়া গেছে, তা প্রকৃত চিত্র নয়।
নিজেদের দুর্বলতার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, আরো প্রশিক্ষণ ও গবেষণার দরকার।
তথ্য জানতে মানুষের অনীহার প্রচুর কারণ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সাদেকা হালিম বলেন, “যেখানে জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছি তখন মাঠপর্যায়ে অন্য চিত্র পাই। আদিবাসীসহ অনেক প্রান্তিক জনগণ যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে যান, তখন ওই কর্মকর্তার হয় পেটে ব্যথা, না হয় বিদেশে গেছে, অনুপস্থিত থাকেন। এটা মানুষকে অনুৎসাহিত করে।”
মতিন খসরুর বক্তব্যে একমত পোষণ করে সাদেকা হালিমও বলেন, আমলান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। তথ্য পেতে প্রচলিত কাঠামো আরো বেশি সহজ করা দরকার।
বিভাগ পর্যায়ে শুনানি করার সুপারিশ
জনবান্ধব আইনটি বাস্তবায়নে জনগণের কাছে পৌঁছাতে কার্যকর উদ্যোগ চেয়েছেন অন্যতম শীর্ষ তথ্য অধিকার কর্মী বেসরকারি সংস্থা রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা।
মেঘনা বলেন, “জনগণের দাবি যাতে সব তথ্য তারা আইনগতভাবে যেনো পায়। কিন্তু এটা খুব কঠিন একটা চ্যালেঞ্জ। এ উদ্যোগ প্রান্তিক জনগণের কাছেও পৌঁছাতে হবে।”
ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নিচের স্তরে অনেক বেশি সচেতনতা দরকার ।”
ভীতি দূর করতে হবে
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরেক তথ্য অধিকার কর্মী আর্টিকেল নাইনটিনের পরিচালক তাহমিনা রহমান বলেন, “জনগণ ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্যে এ তথ্য কমিশন। অধিকার রয়েছে তথ্য পাওয়া, দিতেও সরকার বাধ্য।”
তার প্রশ্ন, “এ আইনটি কতখানি জনগণের কাছে পৌঁছেছে? ৫ বছরে আইন বাস্তবায়নে এ তথ্য কমিশনের স্বাধীনতা কতটুকু ছিল তাও দেখার বিষয়।”
“একবার যখন কোনো আবেদনকারীকে অনুৎসাহিত করা হয় তখন তা আরো বেড়ে যায়। কালচার অফ ফিয়ার তথা জনগণের মধ্যে ভীতি দূর করতে হবে। এ মানসিকতা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “এখনো সরকারি প্রতিনিধির মধ্যে এমন মানসিকতা নেই জনগণকে সেবা করার। নানা ধরনের যে অব্যবস্থাপনা রয়েছে তা সংশোধন করতে হবে।”
তথ্য অধিকার আইনের ৮ সদস্যের মনিটরিং টিমে একজনও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি না রাখার সমালোচনা করেন তাহমিনা।
তথ্য পেতে দুর্ভোগ, তবুও খুশি
তথ্য অধিকার আইন মেনে তথ্য পেতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে নারায়ণগঞ্জের শেখ আলী আহাম্মদের।
ভাইয়ের হত্যা মামলার একজন আসামি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল কি না, তা জানতে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে তথ্য চান তিনি। পরে তথ্য কমিশনে শুনানি শেষে দীর্ঘ সময় পর তা পেতে সমর্থ হন।
বিলম্বে হলেও তথ্য পেয়ে খুশি এ তথ্য সুবিধাভোগী। তবে দায়িত্বে অবহেলার জন্যে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মাত্র এক হাজার টাকা জরিমানা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
বর্তমানে ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ পরিচালক পদে রয়েছেন।
কী তথ্য চেয়েছিলেন: নারায়ণগঞ্জে ২০০৯ সালের এক ঘটনায় মামলা হয়। আলী আহাম্মদের ভাইয়ের হত্যা মামলা এটি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি এসে তথ্য চান তিনি। ২০১২ সালে এক বছর পরে তথ্য পান আলী আহাম্মদ।
বিলম্বে তথ্য পাওয়ায় চার বছরে ওই মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয় বলে জানান ওই ভুক্তভোগী। শেখ আলী আহাম্মদ বলেন, “আমার মনে হয় তথ্য দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের তথ্য দেয়ায় অনাগ্রহ রয়েছে।
“আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একটি তথ্য পাওয়ার জন্য একজন সাধারণ মানুষকে কতটুকু ভোগান্তিতে পড়তে হয়।”
নিজের তথ্য পাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “আমি যে দীর্ঘ লড়াই করেছি তা মোটেও সুখের বিষয় ছিলো না। কয়জন নাগরিক এত কষ্ট করে তথ্য নেবে?”
আলী আহাম্মদের প্রসঙ্গে তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, “আমরা শুরু থেকেই ওনার বিষয়টা অনেক গুরুত্বের সাথে দেখেছি। তথ্য না দেয়ায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে এক হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।”
শেখ আলী আহাম্মদ ওই কর্মকর্তার পদোন্নতি পাওয়ার খবর জানানোর আগে অতিরিক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলোচনাকালে বলেন, সাজার বিষয়টি কর্মকর্তাদের এসিআরে (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) থাকে।
আওয়ামী লীগ নেতা সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু বলেন, সেই কর্মকর্তার অবশ্যই বিচার হবে। তার বিরুদ্ধে মামলাও হবে।
তথ্য অধিকার আইন নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমে প্রচারণার আহ্বান জানান খসরু।
২০০৮ সালের ২০ অক্টোবর তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ পাস হয়। এরপর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ২৯ মার্চ তা সংসদে পাস হয়।
আইন পাসের পর ওই বছরের ১ জুলাই গঠন করা হয় তথ্য কমিশন, যে কমিশন পাঁচ বছর পূর্ণ করতে চলছে।
(তথ্য সংগ্রহে: আশিক হোসেন)